ইদানিং ইস্কনকে নিয়ে প্রচুর আলোচনা সমালোচনা করতে দেখি, হিন্দুদের বিভিন্ন গ্রুপে, পেজে এবং টাইমলাইনে। আমাদের মনে রাখতে হবে তর্ক হবে, কিন্তু যৌক্তিক তর্কের মাধ্যমে আমাদের সীদ্ধান্তে পৌঁছাতে হবে।
ইস্কন সংগঠনটির বিশ্বব্যাপী সনাতন ধর্ম প্রচারে, গীতা প্রচারে, শ্রীমদ্ভাগবত প্রচারে, হরিনাম প্রচারে অনেক অবদান আছে, একথা যেমন সত্যি। তেমনিভাবে এ কথাও সত্যি, ইস্কনের সদস্যবৃন্দরা প্রচুর সত্য-মিথ্যা নিজেদের তৈরি ফতোয়া দেয়।যেমন :
১.নিরামিষ খেলে হবে না, প্রসাদভোজি হতে হবে।২. শিব,কালী,দুর্গা সহ সকলেই কৃষ্ণের দাসদাসি।৩.হিন্দুদের পঞ্চমতের মধ্যে একমাত্র বৈষ্ণব মত ছাড়া সকল মতকেই তারা একরকম মিথ্যা বলে।৪. বিবাহ-শ্রাদ্ধ-পূজাতে তাদের নিত্য নতুন বিধান হিন্দুদের মধ্যে অনৈক্য নিয়ে আসছে।৫. দুর্গাপূজা, কালীপূজা, সরস্বতী এ জাতীয় সর্বজনীন হিন্দু উৎসব আয়োজনে ইস্কনের ঘোরতর অনিহা।
এরকম অসংখ্য উদাহরণ দেয়া যায়।এরপরেও আমরা ইস্কনকে আমাদের সাধ্যানুযায়ী প্রোমট করি, তাদের পাশে থাকি ; কারন তারা শ্রীমদভগবদগীতা এবং ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ভাবাদর্শ প্রচার করেছে বিশ্বব্যাপী প্রত্যেকটি জাতির মাঝে। এ কারণেই তাদের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।
কিন্তু বিশ্বব্যাপী প্রচার করতে গিয়ে তারা হয়তো সম্ভবত ভুলে গিয়েছে, জন্মগত সাদাচামড়ার একজন বিদেশি তাকে সনাতন ধর্ম বলে যা শিখানো হবে, সে তাকেই সত্য বলে গ্রহণ করবে। কিন্তু আমরা যারা জন্মগত হিন্দু, ধারাবাহিক ঋষি পরম্পরায় একবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত এসেছি আমাদের কি যে যা বলবে তাই মেনে নেয়া সম্ভব?
এতদিন আমরা প্রণাম করতাম ভগবানকে সরাসরি সামনে রেখে। ইস্কন নতুন ফতোয়া দিল, ভগবানকে সাইড হয়ে বামপাশে রেখে প্রণাম করতে। যেখানে ভাগবতের একাদশ স্কন্ধেই ভগবানকে সামনে রেখে সরাসরি প্রণামের বিধান দেয়া; সেখানে এ জাতীয় সাইড হয়ে প্রণাম করার বিধান কতটুকু যৌক্তিক? আমাদের বাপদাদা চৌদ্দপুরুষ কি কেউ কখনও এভাবে সাইড হয়ে প্রণাম করেছে?
উত্তর -না করেনি। তাহলে কেন ভাই এই অহেতুক ঝামেলা করতে যাব। ইস্কনের এই সমন্বয় বোধের কমতির কারণেই সাধারণ হিন্দুদের সাথে তারা তত্ত্বগত বিরোধে জড়িয়ে পরছে।
ইস্কনের অধিকাংশ সাধুই শিখাচ্ছে, বিশ্বাসে মিলাই বস্তু তর্কে বহুদূর। কিন্তু বেদাদি শাস্ত্র বলছে, অন্ধভাবে কোন তত্ত্বই গ্রহণ না করতে। শাস্ত্রে আছে, যুক্তিহীন বিচার এবং বিশ্বাসে ধর্মের হানি ঘটে। তবে এ কথাও সত্যি বেশী জানতে গিয়ে, বুঝতে গিয়ে আমাদের মধ্যে তীব্র অনৈক্য বেড়ে যাচ্ছে ।
সনাতন ধর্ম শাশ্বত, কোন সংগঠনের উপরে এ ধর্ম টিকে নাই। যারা মনে করে, একটি সংগঠন ধর্মকে সর্বদা প্রলয় পর্যন্ত রক্ষা করবে, তবে তারা বোকার স্বর্গে বাস করে।হিন্দু জাতির প্রথম সংগঠন করেছে শ্রীশঙ্করাচার্য। তাঁর সংগঠনই আজ প্রায় ম্রিয়মাণ নামসর্বস্ব হয়ে গেছে। লাখ কোটি সংগঠন আসবে, এবং যাবে; শুধুমাত্র সদ্ধর্মই স্বমহিমায় অনন্তকাল থাকবে।
নিজেরা ঘরে যৌক্তিক আলোচনা করা উচিত। কিন্তু বাইরে মতপথ নির্বিশেষে আমাদের এক থাকতে হবে। তত্ত্বগতভাবে আমরা ইস্কনের কিছু ফতোয়ার হয়তো বিরোধিতা করলেও দিনশেষে আমাদের মনে করতে হবে ইস্কন একটা হিন্দু সংগঠন। যে সংগঠন সারাবিশ্বের প্রত্যেকটি জাতির মাঝে সনাতন ধর্ম সংস্কৃতিকে ছড়িয়ে দিচ্ছে। হয়তো এ কারণেই ইসলামি মৌলবাদীগুলি দিনরাত্রি ইস্কনের বিরোধিতা করছে।
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।