বর্তমানে অনেকেরই ধারণা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার সম্পূর্ণটাই বুঝি বা ব্রিটিশদের দান। আমরা এই ভূখণ্ডের অধিবাসীরা অশিক্ষিত চাষা-ভূষা ছিলাম; তাই ব্রিটিশরাই বুঝিবা আমাদের প্রতি দয়া করে আমাদের কাছে প্রথম শিক্ষার আলো নিয়ে এসেছিলো। আবার অনেকে বাংলাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে গায়ের জোরে বলে থাকেন, তুর্কিরাই প্রথম মাদ্রাসা জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে ভারতবর্ষে প্রথম আধুনিক শিক্ষার গোড়াপত্তন করেছিল।
বিদেশি তুর্কিরা প্রধানত তাদের বর্বর সাম্রাজ্যবাদের শেকড় ছড়াতে শুরু করে একাদশ শতাব্দী থেকে । অনুরূপভাবে ব্রিটিশরাও তাদের সাম্রাজ্যবাদী ঘৃণ্য শেকড় ছড়াতে থাকে অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে । তবে এই বিদেশি সাম্রাজ্যবাদীদের কথা কতটা সত্য, তা আজ যাচাই করা প্রয়োজন। বিদেশিদের আগমনের পূর্বে আমাদের এদেশীয়দের কি নিজস্ব শিক্ষা ব্যবস্থা বলতে কিছুই ছিলনা? আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার সবটাই কি আমরা পেয়েছি এই বিদেশি সাম্রাজ্যবাদীদের থেকে?
এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজা আজ বড় প্রয়োজনীয় হয়ে দেখা দিয়েছে । এ ভূখণ্ডের আবহমান সংস্কৃতিকে যারা বুকে ধারণ করে আছে, সেই হিন্দু জাতির আজ দুঃখ-যাতনার অন্ত নেই । সীমাহীন মিথ্যাচারে আবহমান সংস্কৃতিকে ক্ষত-বিক্ষত করে দেবার জন্য আছে একদল তথ্যসন্ত্রাসী। এদের প্রধান লক্ষ্য এ দেশের সংস্কৃতির অভিমুখকে ঘুরিয়ে দিয়ে অতীতের সাম্রাজ্যবাদীদের অপূর্ণ কাজকে বর্তমানকালে পূর্ণ করে তোলা । সে লক্ষ্যেই চলছে তাদের ব্যক্তিগত এবং প্রাতিষ্ঠানিক সর্বপ্রকার কর্মকাণ্ড । এ কর্মকাণ্ডে তারা অনেকটাই প্রায় সফল । কারণ তাদের প্রচারণার ফলে এ ভূখণ্ডের ভূমিপুত্ররা আজ দিশেহারা এবং বিভ্রান্ত। কিশোর, তরুণ, যুবক টেরও পাচ্ছেনা যে অজ্ঞাতসারে তারা কোন সর্বনাশা অন্ধকারময় তথ্যসন্ত্রাসের জালে জরিয়ে যাচ্ছে।
এ জালে জড়িয়ে পড়ার দায় আমাদেরও কোন অংশে কম নয় । ঠিক কতটা ধর্মীয় শিক্ষা দিচ্ছি আমরা আমাদের ছেলে মেয়েদের। এককথায় বলতে গেলে কিছুই না। আজ পড়াশুনার পাশাপাশি নাচ, গান, কবিতা, আবৃতি, খেলাধুলা সবকিছু শেখার সময় এবং টাকা পয়সা আমাদের আছে। শুধু একরাশ কার্পণ্য ধর্মীয় শিক্ষার ক্ষেত্রে । এর ফল তো আমরা হাতেনাতেই চারপাশে দেখতে পাচ্ছি। কি হচ্ছে! কোর্টে যখন ছেলে মেয়ে ধর্মান্তরিত হয়, তখন মা-বাবা কেঁদে কেঁদে বুক ভাসিয়ে ফেললেও কোন লাভ তো হয়ইনা; উল্টো সেই ছেলে অথবা মেয়ের অচিন্ত্য, অস্রাব্য, অসভ্যতা পিতা মাতার সর্বসমক্ষে হজম করতে হয়।
আর ধর্মীয় শিক্ষার নামে আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের যা শিক্ষা দিচ্ছি, তা হল কতগুলো ঠাকুমা-দিদিমার অসার গালগল্প । অবাস্তব, অলৌকিক পৌরাণিক উপাখ্যান এবং আশাস্ত্রীয় কিছু ব্যক্তিগত মতের কৃত্রিম কথার ফুলঝুড়ি । বেদ আমাদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ । বেদের উপরেই সনাতন ধর্ম প্রতিষ্ঠিত । সেই বেদের ছিটে-ফোঁটাও কতটা আচরিত আছে আমাদের জনজীবনে? খুব একটা নেই বললেই চলে। বৈদিক সৃষ্টিতত্ত্ব যা কি-না পুরোটাই প্রায় বিজ্ঞানসম্মত। অথচ আমরা আমাদের সন্তানদের শিক্ষা দেই, মধু-কৈটভের মেদ থেকেই পৃথিবীর সৃষ্টি। এ কারণেই পৃথিবীর আরেক নাম মেদিনী। কথাগুলো আমাদের দেশের সরকারি শিক্ষা বোর্ডের পাঠ্যপুস্তকে পর্যন্ত আছে। পুরাণের এ তথ্যের হয়তো কোন রূপক ব্যাখ্যা আছে । কারণ পুরাণগুলোর তৈরীই হয়েছে রূপকের মাধ্যমে, গল্পের মাধ্যমে বৈদিক জ্ঞানের প্রকাশ ঘটানোর জন্য । আমরা যদি সেই রূপকগুলোকে ধরতেই না পারি, তবে সমস্যা তো দিনেদিনে বাড়বেই। পুরাণগুলোর অনেক কথাই ব্যঞ্জনা এবং লক্ষণা অলঙ্কারের মাধ্যমে বলা । তাকে যদি আমরা অভিধা বা আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করি তবে অর্থের বিকৃতি তো ঘটবেই । অর্থাৎ অলঙ্কারের মাধ্যমে সাহিত্যে যা বলা হয়েছে তার সবটাই আভিধানিক অর্থে গ্রহণ করা যাবে না । তাই পুরাণগুলোকে গ্রহণ-বর্জনের মাধ্যমেই একমাত্র গ্রহণ করতে হবে। পুরাণগুলোতে যেমন অসাধারণ অনেক উপাদান আছে, তেমনি আছে আপত্তিকর অনেক তথ্যাবলি। তাই পুরাণের সবটুকুই গ্রহণযোগ্য নয়।
একটা টেবিলে কিছু ভালো ফল আছে এবং গুটিকয়েক পঁচা ফলও আছে। একটা শিশু ফল খাবার জন্য দৌড়ে এসে যদি সেই গুটিকয়েক পঁচা ফলের উপরই তার হাত বাড়ায়, এবং মুখে দিয়ে বুঝতে পারে ফলটি পঁচা; তবে থু দিয়ে সে শুধুমাত্র পঁচা ফলটি ফেলে দিবে তাই নয়, তার ধারনা হবে টেবিলের সব ফলই বুঝি পঁচা এবং হাজার চেষ্টা করেও শিশুটিকে বোঝানো প্রায় অসম্ভব হয়ে যাবে যে টেবিলে ভাল ভাল সরস ফলও আছে । তার ধারণা জন্মাবে টেবিলের সব ফলই বুঝি পঁচা । এমনটাই প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে প্রায় প্রত্যেকটা হিন্দু পরিবারে । শিশু বয়সে তাকে ঠাকুমা দিদিমার গালগল্পের মাধ্যমে যে ধর্মীয় শিক্ষা দেয়া হচ্ছে তার ভিৎ দিন দিন নরবরে হয়ে যায় বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে । একুশ-বাইশ বছরের দিকে যখন তার বুদ্ধি পূর্ণতা পায়, তখন সে ভাল মন্দ বিচার করতে পারে ; তখন এ ভাল মন্দ বিচার করতে যেয়েই সে ধান এবং ধানের চিটাকে একাকার করে ফেলে এবং অজ্ঞানতার জন্য চিটার সাথে সাথে ধানকেও ঝেড়ে ফেলে দেয় । সঠিক-বেঠিক বোধটাকে সে গুলিয়ে ফেলে। পরিণামে সে হয়ে ওঠে অবিশ্বাসী । এ অবিশ্বাসের মাত্রা দিন দিন বাড়তে বাড়তেই সে হয়ে যায় ঘোরতর নাস্তিক । পরিণামে সে পরিবার, সমাজ, ধর্ম, সংস্কৃতির, মহাবৈরী হয়ে যায় ।
কিন্তু এর জন্য দায়ী কারা ? আমরাই । কারণ আমাদেরই দায়িত্ব ছিলো শিশুটিকে প্রকৃত বৈদিক শিক্ষা দেয়া এবং তা দিতে পারিনি বলেই আজ এ ঘটনা ঘটেই চলেছে । কিন্তু এ প্রপঞ্চকে আর কতদিন চলতে দেয়া যায় এবং এ প্রপঞ্চের অভিঘাতে আর কত পরিবার ধ্বংস হয়ে যাবে ? এর সমাধানে একটি কথাই বলতে হয় , তা হলো অনেক হয়েছে এবার মূলে ফিরুন।অর্থাৎ বেদ-বেদান্তের পথে আসুন। বেদমাতার সর্বদা শরণে থাকুন। আমরা হয়তো অনেকেই জানি না বেদের মধ্যেই অথর্ববেদে একটি বেদমাতাস্তোত্র আছে। বেদমাতাকে কিভাবে স্তোত্র করতে হবে তা বেদমাতা নিজেই আমাদের শিখিয়ে দিয়েছেন। সেখানে সুস্পষ্টভাবে বলা আছে যে, আমরা যদি বেদমাতার সর্বদা শরণে থাকি,তবে তিনি আমাদের অনন্ত জ্ঞান দান করে দ্বিতীয় জন্মদান করে দ্বিজ করে তুলবেন। তিনি আমাদের পবিত্র করে জীবনীশক্তি দান করবেন। সন্তানধারাকে রক্ষা করবেন। তিনি আমাদের সহ সম্পদ সহ কৃতি দান করবেন এবং সর্বোপরি ব্রহ্মতেজ দান করবেন। এরপরও কি আমরা বিভ্রান্ত হয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়াবো দিনের পর দিন। বেদের মধ্যে বেদকেই 'বেদমাতা' বলে সম্বোধন করা হয়েছে। বিষয়টি আমাদের প্রায় সকল শাস্ত্রগ্রন্থেই আছে। তাই বেদ পরবর্তী অন্যকোন নবীন শাস্ত্রগ্রন্থকে বেদমাতা বলে সম্বোধন করা উচিত নয় বলে আমি মনে করি।কিন্তু ইদানিং আমরা অনেক গ্রন্থকে বেদমাতা বলে সম্বোধন করা হয়। বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক এবং অশাস্ত্রীয়।
স্তুতা ময়া বরদা বেদমাতা প্রচোদয়ন্তাং পাবমানী দ্বিজানাম্।
আয়ুঃ প্রাণং প্রজাং পশুং কীর্তিং দ্রবিণং ব্ৰহ্ম বর্চসম্৷।
মহ্যং দত্ত্বা ব্ৰজত ব্রহ্মলােকম্৷।
(অথর্ববেদ: ১৯.০৭.১২)
"অনন্ত প্রেরণাদাত্রী, জীবকে জ্ঞানদান করে দ্বিতীয় জন্মদান করে পবিত্ৰকারিণী, বরদা বেদমাতার আমি স্তুতি করছি। হে মাতা! আমাকে শতবছর পূর্ণায়ু,অনন্ত প্রাণশক্তি, সন্তানধারা, পশুসম্পদ সহ বিবিধ সম্পদ, অনন্য কীর্তি এবং ব্রহ্মতেজ আমাকে অর্পণ না করে তুমি যেও না।"
সনাতন ধর্ম সভ্যতার সবকিছুই বেদের উপর প্রতিষ্ঠিত। ঋষিদের ভাষায় বলতে হয় - বেদ অখিল ধর্মের মূল। তাই যতদিন আমরা বেদমাতা থেকে বিচ্যুত থাকব ততদিন আমাদের বর্তমান কালের মত হতভাগা হতচ্ছারার মত দিন কাটাতে হবে । কিন্তু যখন আমরা বেদ মাতার কোলে চড়ে তার অমৃতময় স্তন্যরূপ পরা-অপরা জ্ঞানরাশি আস্বাদ করতে পারবো তখনই আমাদের জাতির জীবনে এক নতুন সূর্যোদয় হবে । যার প্রত্যাশাতেই আমাদের এ মূলে ফেরার আহ্বান। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও তাঁর জগদ্বিখ্যাত 'গীতাঞ্জলি' কাব্যে স্বপ্ন দেখেছেন, একদিন সকল মতপথ নির্বিশেষে একে অন্যের প্রতি সকল বিভেদ ভুলে একটি বিশালহৃদয় ধারণ করে সেই বৈদিক সাম্যবাদে ফিরতে পারব। বৈদিক যজ্ঞশালার দ্বার আজ সকলের জন্যে খোলা হয়েছে। সেই ঐক্যের পথেই সবাইকে মিলতে হবে আনতশিরে।
"হেথা একদিন বিরামবিহীন
মহা ওঙ্কারধ্বনি,
হৃদয়তন্ত্রে একের মন্ত্রে
উঠেছিল রণরণি।
তপস্যা-বলে একের অনলে
বহুরে আহুতি দিয়া।
বিভেদ ভুলিল, জাগায়ে তুলিল
একটি বিরাট হিয়া।
সেই সাধনার সে আরাধনার
যজ্ঞশালায় খোলা আজি দ্বার,
হেথায় সবারে হবে মিলিবারে
আনতশিরে-"
একটা সময় ছিল যখন আমরা পড়ালেখা জানতাম না এবং এ শাস্ত্র গ্রন্থগুলোও আমাদের হাতের কাছে ছিলো না । এগুলো ছিল হাতে লেখা পুঁথি । তখন খুব কম মানুষই পড়ালেখা জানত এবং সেই পড়ালেখা জানা মানুষের মধ্যে খুব কম লোকই সেই গ্রন্থগুলো পড়ার সুযোগ পেতো । কিন্তু আজ তো সেই সমস্যা নেই । আজ আমরা নতুন প্রজন্মের প্রায় অধিকাংশই পড়ালেখা জানি। এর সাথে আমাদের শাস্ত্রগ্রন্থগুলো হাতেলেখা পুঁথি থেকে আজ প্রেসে ছাপা পুস্তক আকারে আমাদের কাছে এসেছে। তাহলে আমাদের আজ যথাসাধ্য বৈদিক জ্ঞান নিয়ে মত-পথ নির্বিশেষে বৈদিকপথে চলতে কিসের এত কার্পণ্য?
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।