-->

ধর্ম নির্ণয়ে বেদই একমাত্র প্রমাণ; পুরাণ এবং স্মৃতি সহায়ক মাত্র

বর্তমানে সনাতন ধর্মাবলম্বী কিছু ব্যক্তি প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদকে পাশ কাটিয়ে শুধু পৌরাণিক গ্রন্থ অথবা বিভিন্ন বাবাগুরুদের লেখা ছড়ার বই, গ...

শঙ্খিনী সাপ বিষাক্ত হলেও, মানুষের শত্রু নয়।

শঙ্খিনী সাপ বিষাক্ত হলেও, মানুষের শত্রু নয়।
জন্মগত বংশীয় শত্রুতা আমৃত্যু থাকে। যেমন সাপে বেজির শত্রুতা জন্মগত। জলের সাপ সাধারণত মানুষকে কামড়ায় না, তবুও মানুষ সাপ দেখলে আজন্ম সংস্কারবশত ভয় পায়।

সিজোফ্রেনিয়া হল, একটি জটিল মানসিক অসুস্থতা।এ রোগের আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে দ্বিখণ্ডিত সত্ত্বা বিরাজ করে। অর্থাৎ একটি মানুষের মাঝে লুকিয়ে থাকে, আরো একটি মানুষ। নিজের চারপাশের জগৎকে অপ্রকৃতস্থ ভাবে দেখা এবং সে দৃষ্টিতে ব্যাখ্যা করাই হল সিজোফ্রেনিয়া। সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তি দৈনন্দিন স্বাভাবিক কাজকর্ম স্বতঃস্ফূর্তভাবে করতে পারে না। আশেপাশের সকলের প্রতি একটি অকারণ সন্দেহ প্রবণতা তৈরি হয়। সে মনে করে সকলেই তার ক্ষতি করবে; সকলেই তাকে মেরে ফেলতে চাচ্ছে; তার সাথে অকারণ শত্রুতা করছে; তার বিদ্যা অন্যে চুরি করতে চাচ্ছে ইত্যাদি। মনজগতের অলীক কল্পনায় ফলে স্বাভাবিক জীবনে বিশৃঙ্খলতা দেখা দেয়; সর্বদা অকারণ মৃত্যুভয় তাড়া করে ফেরে তাদের।
আমাদের অনেকের মধ্যেই নিজের অজ্ঞাতসারে সিজোফ্রেনিয়ার প্রাথমিক স্তর বাস করে। বিষয়টি আমরা অনেকেই টের পাই না। নিজের তৈরি করা একটি 'ইউটোপিয়া' তৈরি করে সেখানেই রাজা হয়ে বসে থাকি। জগতকে দেখি স্বার্থের চোখ দিয়ে, শত্রুতার চোখ দিয়ে। আজন্ম লালিত সংস্কারে সাপকে দেখে আমরা ভয় পাই; কিন্তু সাপ মানেই যে শত্রু, তা নয়। আমাদের আশেপাশের সকল সাপই বিষাক্ত নয়; আবার সকল বিষাক্ত সাপই শত্রু নয়।পরিবেশে এমন কিছু সাপ আছে, যা বিভিন্ন বিষাক্ত সাপ খেয়ে দিনশেষে আমাদের উপকার করে। আমরা যদি তাদেরও শত্রু বানিয়ে ফেলি, তবে বিষয়টি দুঃখজনক।
জীবন চলতে সবসময় আমরা শত্রুমিত্র বুঝতে পারি না অনেক সময়। আশেপাশের সকলকেই শত্রু মনে করি। কিন্তু গভীর দৃষ্টিতে দেখলে দেখা যায় সে শত্রু ছিল না, ছিল মিত্র। এর অসংখ্য উদাহরণ দেয়া যায় প্রকৃতি থেকে। একটি সুন্দর উদাহরণ হল 'শঙ্খিনী সাপ।' বাংলাদেশের বিশেষ করে খুলনা অঞ্চলের শঙ্খিনী সাপটিকে বেশী দেখা যায়। শঙ্খিনী সাপের বহুল প্রচলিত আরেকটি নাম হল 'শাখামুটি'। ইংরেজিতে সাপটির নাম 'বেন্ডেড ক্রেইট'। সাপটির লেজের অংশটি দেখতে অনেকটা সাপের মাথার মত ভোঁতা , তাই একে দুইমাথাওয়ালা সাপও বলে। বর্তমানে শঙ্খিনী সাপ বিলুপ্তির পথে।সাপটি মারাত্মক বিষধর হলেও শঙ্খিনী সাপ খুবই নিরীহ; মানুষকে কামড়ায় না বললেই চলে। যারা সাপ নিয়ে কাজ করে তারা এটিকে কেঁচোর মত নাড়াচাড়া করে। শঙ্খিনী সাপ রাতে বের হয়ে কালাচ,চন্দ্রবোড়া সহ অন্যান্য বিষাক্ত সাপকে খেয়ে ফেলে। এর জন্য যেখানে শঙ্খিনী সাপ থাকে, সে সকল এলাকায় মানুষের জন্য ক্ষতিকর; অন্যান্য বিষাক্ত সাপ যাদের কামড়ে প্রতি বছর বাংলাদেশে অসংখ্য মানুষ মারা যায় তারা থাকে না বা একেবারে সংখ্যায় কম থাকে। এ কারণে প্রাণী বিজ্ঞানীরা শঙ্খিনী সাপকে পুষে রাখার পরামর্ষ দিয়েছেন। তবে একথা স্মর্তব্য, শঙ্খিনী সাপেরও তীব্র বিষ আছে। কিন্তু বিষাক্ত শঙ্খিনী শত্রুর চেয়ে মানুষের বন্ধু বেশি। তাই তার সাথে শত্রুতা করা অহেতুক।
সাপটি বাংলাদেশের অন্যতম উপকারী একটি সাপ। সাপটি রাসেল ভাইপারসহ বাংলাদেশের যেকোন বিষাক্ত সাপকে খেয়ে ফেলতে পারে। কিন্তু মানুষ সন্দেহ শত্রুতার বশে ভয়ংকরভাবে গত দশ বছরে এ বন্ধু সাপটিকে হত্যা করে একরকম প্রায় নিঃশেষ করে দিয়েছে। প্রকৃতি শূণ্যস্থান পছন্দ করে না, ফলে এর খাবার বিষাক্ত রাসেল ভাইপার সাপের বৃদ্ধি ঘটেছে প্রচণ্ডভাবে।আজ থেকে পাঁচ বছর আগেও বাংলাদেশে রাসেল ভাইপারের আনাগোনা খুব কমই ছিল। ধারণা করা হয়, শঙ্খিনী সাপ নিঃশেষ হয়ে যাওয়ায় বন্যার জলের সাথে ভারত থেকে আসছে এ বিষাক্ত সাপটি। রাসেল ভাইপার এতটাই বিষাক্ত যে, এর এক ফোঁটা টক্সিনে কয়েক মিনিটে শতশত মানুষ মারা যেতে পারে। অর্থাৎ এ সাপে কামড়ালে মানুষ হাস্পাতালের যাওয়ার সময়টুকুও পায় না। রাসেল ভাইপার বা চন্দ্রবোড়ার বংশবৃদ্ধি ঘটে খুবই দ্রতগতিতে। এরা বছরে ৪০ থেকে ৬০টি বাচ্চা দেয়; এমনকি কোন কোন চন্দ্রবোড়া সাপ বছরে ৭৫টি পর্যন্ত বাচ্চা দেয়।
এবার আসি আমাদের আলোচনায়, আমরা অনেক সময়েই আমাদের আশেপাশের যাদের শত্রু মনে করি তারা সকলেই শত্রু নয়। এদের মধ্যে শঙ্খিনী সাপের মত কিছু মানুষের বন্ধু সাপও আছে। শঙ্খিনী সাপটি মানুষ দেখলে পালিয়ে যায়, এমনকি আঘাত করলে প্রত্যাঘাতও করেনা; মাঝেমধ্যে ব্যতিক্রম ছাড়া। উপকারী শঙ্খিনী সাপকে মেরে ফেলাতে আমাদের চারপাশে মানুষের জন্য সত্যিকারের হুমকিস্বরূপ রাসেল ভাইপার বা চন্দ্রবোড়ার বংশবৃদ্ধি প্রচণ্ডভাবে ঘটছে।শঙ্খিনীদের সংখ্যা যদি কমে না যেত, তবে চন্দ্রবোড়ার বংশবৃদ্ধি কখনই এভাবে ঘটত না।
আমরা অনেকেই বুঝতে পারি না যে, জীবনে সকলের প্রয়োজন আছে। কাউকে হয়ত বুকপকেটে রাখতে হয়, কাউকে প্যান্টের পকেটে।প্রয়োজনই বলে দিবে কে কোথায় থাকবে।আপদকালে বাঁচার পদ্ধতিও এবং শত্রু দমনের পদ্ধতি আমাদের মহাভারতের (আদিপর্ব, ১৩৫ অধ্যায়) আদিপর্ব সহ বিভিন্ন স্থানে বিস্তৃতভাবে বলা আছে। সকল সমস্যা সমাধানে সাম, দান,ভেদ এবং দণ্ড এ চারপ্রকারের পদ্ধতির প্রয়োগ করতে হবে।
সাম – আলোচনার দ্বারা সমস্যা বা বিরোধের সমাধান করা। শত্রুপক্ষকে যৌক্তিক কথা দ্বারা বশীভূত করা। সমস্যা সমাধানে অকারণে শত্রুতা না করে, মৈত্রীসূত্রে আবদ্ধ হওয়া।
দান – অপ্রয়োজনীয় বিরোধে না গিয়ে, বিভিন্ন উপহার দিয়ে শত্রুর সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করা। প্রয়োজনে, কিছু ক্ষতিপূরণ দিয়ে সম্পর্ক রক্ষা করে এবং শত্রুর সাথে অহেতুক দন্দ্ব রহিত করা।
ভেদ – অত্যন্ত প্রচেষ্টার ফলে পূর্ববর্তী দুটি পদ্ধতি সাম এবং দান যদি নিস্ফল হয়, তবে তৃতীয় পদ্ধতি ভেদকে অত্যন্ত সুকৌশলে প্রয়োগ করতে হবে। শত্রুর শত্রু খুঁজে তাদের মধ্যে ভেদ সৃষ্টি করতে হবে, যাতে শত্রু তার অন্য শত্রুদের নিয়েই ব্যস্ত থাকে আপনার দিকে না আসতে পারে। একেই ইংরেজিতে “Divide & Rule” তত্ত্বও বলে।
দণ্ড –পূর্ববর্তী তিনটি পদ্ধতি যদি নিস্ফল হয়,তবে চতুর্থ এবং শেষ পদ্ধতি হল দণ্ড বা শাস্তি। শত্রুকে বল প্রয়োগ দ্বারা, অস্ত্র প্রয়োগ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত করা; পরাভূত করা।তখন দণ্ড প্রয়োগেই ধর্ম হয়। তখন দণ্ড প্রয়োগ না করে ভীরুর মত পিছিয়ে আসা বা শত্রুকে ক্ষমা প্রদর্শন করাটা অধর্ম।
চাণক্য শ্লোকে আছ, "শঠে শাঠাং সমাচরেৎ।" শত্রু যদি শঠ হয়, তখন তার সাথে বড় শঠতার আশ্রয় নিয়ে তাকে নিরস্ত্র করতে হবে। একেই বাংলা প্রবাদবাক্যে বলে, "যেমন কুকুর, তেমন মুগুর।" দণ্ড প্রয়োগের আগে আবশ্যই সাম,দান এবং ভেদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করে দেখতে হবে। যেন শত্রুর সাথে শত্রুতা দণ্ড পর্যন্ত চলে না যায়। কিন্তু দণ্ড পর্যন্ত যদি চলেই আসে, তবে কিছুই আর করার নেই; নিঃশঙ্কচিত্তে দণ্ডের প্রয়োগ করতে হবে। সাপেরা বিষাক্ত হলেও, শঙ্খিনী সাপ যেহেতু অন্য বিষাক্ত সাপদের খেয়ে প্রকারান্তরে উপকারই করে; তাই তাদের সাথে শত্রুতা না করে সাথে রাখলে ক্ষতি নেই। বরং উপকারই হয়, এরা রাসেল ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া সহ বিষাক্ত সাপদের খেয়ে প্রকারান্তরে উপকারই করে। জগতের সকলেই আপনার শত্রু নয়। এ জগত একটি আয়নার মত, আপনি যেমন তেমনই তাতে আপনার প্রতিবিম্ব দেখবেন। তাই অহেতুক সন্দেহ প্রবণতা, শত্রু মানসিকতা মানুষকে অস্থির করে।অনেক সময়ই সিজোফ্রেনিয়ার মত জটিল মানসিক অসুস্থতার দিকে মানুষকে ঠেলে দিয়ে মৃত্যুমুখে পতিত করে।
জীবনে প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া শিক্ষাগুলি দেখে শুনেও, আমরা জীবনে খুব একটা ব্যবহার করি না। জীবন মানেই ভারসাম্য, জগতে কারো সাথেই কারো মতামত শতভাগ মিলবে না, তাই বলে কি তাদের সবাইকে শত্রু বানিয়ে ফেলা কোন বুদ্ধিদীপ্ত কাজ নয়। মানুষ মাত্রই মতের অমিল হবে, কারো সাথে মতের অমিল হলে, তাকেই শত্রু বানিয়ে ফেলাটা বোকামির নামান্তর। তাই প্রচেষ্টা করতে হবে, মতের সাথে অমিল থাকলেও ; তা যেন ব্যক্তিগত শত্রুতার পর্যায়ে না যায়। কাউকে শত্রু বানানো সহজ, কিন্তু বন্ধু বানাতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। আমরা আপাতদৃষ্টিতে যাদের শত্রু মনে করছি, তাদের থেকে একটি অংশকে যদি সাম-দানের মাধ্যমে আমাদের দিকে নিয়ে আসতে পারি, তবে প্রকারান্তরে আমাদের লাভ ছাড়া ক্ষতি নেই। কি দরকার অহেতুক শত্রুর সংখ্যা বৃদ্ধি করে?
সহকারী অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ, বাংলাদেশ।।
মন্তব্যগুলো দেখুনমন্তব্যগুলো লুকান🙁