আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় |
বাঙালি তথা ভারতবর্ষের বিজ্ঞানের অন্যতম অগ্রনায়ক #আচার্য_প্রফুল্লচন্দ্র_রায় ১৮৬১ সালের ২ আগস্ট খুলনা জেলার রাড়ুলী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন বহুভাষাবিদ, সুপণ্ডিত, সমাজসেবী ও বিদ্যোৎসাহী হরিশচন্দ্র রায় চৌধুরী এবং মাতা ভুবনমোহিনী দেবী। জমিদার পরিবারে জন্ম হলেও, তিনি ছোটবেলা থেকেই ছিলেন সাধারণ জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত। বিজ্ঞানে অনন্য অসাধারণ অবদানের জন্যে তাঁর জন্মদিনটিকে পশ্চিম বাংলায় #বিজ্ঞানদিবস হিসেবে পালন করা হয়।
১৮৭৯ সালে তিনি কোলকাতার আলবার্ট স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাশ করে প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াশোনা করেন।১৮৮২ সালে গিলক্রাইস্ট বৃত্তি নিয়ে লন্ডন থেকে বি.এস.সি পাশ করেন।১৮৮৭ সালে রসায়ন শাস্ত্রে মৌলিক গবেষণার জন্যে এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি.এস.সি ডিগ্রী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের হোপ পুরষ্কার লাভ করেন।
১৮৮৯ সালে কোলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে রসায়নের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করে পরাধীন ভারতবর্ষের বিজ্ঞান শিক্ষায় মন -প্রাণ সমর্পণ করেন। পরে তিনি ১৯১১ সালে বিভাগীয় প্রধান এবং অধ্যাপক পদে উন্নীত হন।
১৯০১ সালে "বেঙ্গল কেমিক্যাল এবং ফার্মাসিটিক্যাল ওয়ার্কস লিমিটেড" এর প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র বাংলায় প্রথম সার্থক রাসায়নিক দ্রব্য এবং ঔষধের কারখানা স্থাপন করেন। ১৯০১ সালে স্থাপিত বেঙ্গল কেমিক্যাল এ প্রতিষ্ঠানই আজ শুধুমাত্র ভারতবর্ষ নয়, করোনা মোকাবেলায় সারা বিশ্বের অন্যতম ভরসাস্থল হয়ে উঠছে।কারণ একমাত্র বেঙ্গল কেমিক্যালসেরই ব্যাপকভাবে হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন উৎপাদনের সক্ষমতা আছে। তাই বিশ্বে বর্তমানকালের করোনা মহামারী নামক অভূতপূর্ব বিপদে বেঙ্গল কেমিক্যালসই অন্যতম ভরসা।
আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের প্রতিষ্ঠানের উদ্ভাবিত হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন করোনা চিকিৎসায় ব্যাপক কার্যকর এবং ফলদায়ক বলেই, এ ওষুধটি চেয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। অবশ্য কোটি কোটি মানুষের প্রাণ বাঁচাতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি শেষ পর্যন্ত হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন নামক ম্যালেরিয়ার ওষুধটি দিতে সম্মতও হয়েছেন
বিজ্ঞানে বহু মৌলিক আবিষ্কারের কারণে তিনি বাংলা এবং ভারতে তাঁর সমসাময়িক প্রায় সকল বিজ্ঞান সভার সভাপতিত্ব করেন।বিশুদ্ধ বিজ্ঞান বিশেষ করে রসায়ন শাস্ত্র ছাড়াও তিনি বহু সামাজিক সমস্যায় আমাদের করণীয়, বর্জনীয় বিষয় নিয়ে লিখে গিয়েছিলেন আমৃত্যু। বিজ্ঞান, অর্থনৈতিক, সমাজভাবনা,সাহিত্য, শিল্প,শিক্ষা, আত্মবিক্ষা, রাজনীতি, রবীন্দ্রনাথ, প্রকৃতি ও পরিবেশ ; কি নেই তাঁর লেখায়। তিনি এককথায়, বিস্ময়কর প্রতিভাবান।
তাঁর গবেষণার সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তিরূপে ধরা হয় প্রাচীন ভারতে হিন্দুদের বিজ্ঞান সাধনার ইতিহাসের গ্রন্থ - 'হিস্ট্র অব হিন্দু কেমিস্ট্রি (দুই খণ্ডে) ' এ অমূল্য গ্রন্থটি। একবুক বিস্ময় নিয়ে এ বইটি পড়লাম। অবাক হলাম যে ১৯০২ সালে তিনি এ বইটির প্রথম খণ্ড প্রকাশ করেন ; কিন্তু আজ ২০১৬ তে এসেও এ বই আমাদের হাতের সীমানার বাইরে! এ বইয়ের প্রত্যকটি তথ্য জানা আমাদের একান্ত প্রয়োজন। কিন্তু এ সকল প্রাচীন গৌরবের তথ্য জানিনা বলেই, আমরা বাঙালিরা দিনে দিনে হতচ্ছাড়া, লক্ষ্মীছাড়া হয়ে যাচ্ছি। আমাদের প্রাচীন গৌরব যদি সঠিকভাবে নাই জানি, তবে আমাদের মধ্যে স্বাভিমান, আত্মশ্লাঘাবোধ জাগবে কি করে?
বাংলায় রসায়নের চর্চার আকাঙ্ক্ষায় তিনি ১৯২৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে দুইলক্ষ টাকা দান করেছিলেন। সেই সময়ের দুইলক্ষ টাকা আজ হয়তো তা কয়েকশো কোটি টাকা হবে। ভাবা যায়!
বাংলা ২৫ অগ্রহায়ণ ১৩৩৯ এবং ইংরেজি ডিসেম্বর ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার টাউন হলে অনুষ্ঠিত হয় আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের ৭০তম জন্মবার্ষিকী উৎসব। এ সভায় সভাপতিত্ব করেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর লিখিত অভিভাষণে প্রফুল্লচন্দ্র রায় সম্প্ররকে যা বলেন তা খুবই গুরুত্ববহ এবং রবীন্দ্রনাথের মানপত্রেই দীপ্ত প্রতিভাসিত হয়ে ওঠে এক নিঃস্বার্থ, কর্মযোগী বিজ্ঞানীর আত্মস্বরূপ ; যে কথাগুলি আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রকে জানতে বর্তমানকালেও জন্যেও আমাদের জন্যে সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। কবিগুরু বলেন -
“আমরা দুজনে সহযাত্রী।
কালের তরীতে আমরা প্রায় এক ঘাটে এসে পৌঁচেছি। কর্মের ব্রতেও বিধাতা আমাদের কিছু মিল ঘটিয়েছেন।
আমি প্রফুল্লচন্দ্রকে তাঁর সেই আসনে অভিবাদন জানাই, যে আসনে প্রতিষ্ঠিত থেকে তিনি তাঁর ছাত্রের চিত্তকে উদ্বোধিত করেছেন -
কেবলমাত্র তাকে জ্ঞান দেন নি, নিজেকে দিয়েছেন, যে দানের প্রভাবে ছাত্র নিজেকেই পেয়েছে।
বস্তুজগতে প্রচ্ছন্ন শক্তিকে উদ্ঘাটিত করেন বৈজ্ঞানিক, আচার্য প্রফুল্ল তার চেয়ে গভীরে প্রবেশ করেছেন, কত যুবকের মনোলোকে
ব্যক্ত করেচেন তার গুহাহিত অনভিব্যক্ত দৃষ্টিশক্তি, বিচারশক্তি, বোধশক্তি। সংসারে জ্ঞানতপস্বী দুর্লভ নয়, কিন্তু মানুষের মনের
মধ্যে চরিত্রের ক্রিয়া প্রভাবে তাকে ক্রিয়াবান করতে পারেন এমন মনীষী সংসারে কদাচ দেখতে পাওয়া যায়।
উপনিষদে কথিত আছে, যিনি এক তিনি বললেন, আমি বহু হব। সৃষ্টির মূলে এই আত্মবিসর্জনের ইচ্ছা। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের সৃষ্টিও
সেই ইচ্ছার নিয়মে। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে তিনি বহু হয়েচেন, নিজের চিত্তকে সঞ্জীবিত করেচেন বহু চিত্তের মধ্যে। নিজেকে
অকৃপণভাবে সম্পূর্ণ দান না করলে এ কখনো সম্ভব হোত না। এই যে আত্মদানমূলক সৃষ্টিশক্তি ও দৈবীশক্তি। আচার্যর এই শক্তির
মহিমা জরাগ্রস্ত হবে না। তরুণের হৃদয়ে হৃদয়ে নবনবোন্মেষশালিনী বুদ্ধির মধ্য দিয়ে তা দূরকালে প্রসারিত হবে। দুঃসাধ্য
অধ্যবসায়ে জয় করবে নব নব জ্ঞানের সম্পদ। আচার্য্য নিজের জয়কীর্ত্তি নিজে স্থাপন করেছেন উদ্যমশীল জীবনের ক্ষেত্রে, পাথর
দিয়ে নয় -প্রেম দিয়ে। আমরাও তাঁর জয়ধ্বনি করি।
প্রথম বয়সে তাঁর প্রতিভা বিদ্যাবিতানে মুকুলিত হয়েছিল ; আজ তাঁর সেই প্রতিভার প্রফুল্লতা নানা দলবিকাশ করে দেশের হৃদয়ের
মধ্যে উদ্বারিত হোলো। সেই লোককান্ত প্রতিভা আজ অর্ঘ্যরূপে ভারতের বেদীমূলে নিবেদিত। ভারতবর্ষ তাকে গ্রহণ করেছেন, সে
তাঁর কণ্ঠমালায় ভূষণরূপে নিত্য হয়ে রইল। ভারতের আশীর্বাদের সঙ্গে আজ আমাদের সাধুবাদ মিলিত হয়ে তাঁর মাহাত্ম্য
উদঘোষণ করুক।”
(রবীন্দ্র রচনাবলী : অষ্টাদশ খণ্ড, প্রবন্ধ ব্যক্তিপ্রসঙ্গ, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, পৃ. ৯৮-৯৯)
সারা জীবনব্যাপী বাংলা মায়ের সেবা করেছেন ; বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তো বটেই সাথে সাথে ধর্ম, সমাজ, সংস্কৃতি এবং রাজনীতি সহ সকল ক্ষেত্রে । কিন্তু আজ বলতে খুব খারাপ লাগছে যে, তাঁর মাতৃভূমি এই বাংলাদেশে কি তিনি তাঁর যোগ্য সম্মান পেয়েছেন? এতকাজের পরেও কেন তিনি তাঁর মাতৃভূমি বাংলাদেশে অবহেলিত! যিনি এদেশে বিজ্ঞান প্রযুক্তির অগ্রনায়ক, তাঁর নামে কি দেশে এতোগুলো বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে একটিরও নামকরণ করা যেত না? অথবা তাঁর নামে অন্ততপক্ষে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা হলেরও তো নামকরণ করা যেত! কিন্তু হয়নি, এটাই বাস্তবতা। এখানেই কবি নিরব। শুধুমাত্র মুখেমুখেই অমরকাব্য লিখি আমরা।
যতদিন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের মতো জ্ঞানবিজ্ঞান সাধকেরা তাঁদের যোগ্যসম্মান না পেয়ে, অবহেলার ধুলোতে পরে থাকবে; ততোদিন এ জাতি, এ দেশ প্রকৃত অর্থে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। নতুন প্রজন্মের সকলকে আহ্বান করব আচার্যের জীবনী এবং রচনাবলী পাঠের, তাহলে কিছুটা হলেও তাঁর অপরিশোধ্য ঋণ শোধ হবে আমাদের।