বেদে পরমেশ্বরের মূর্ত এবং অমূর্ত দুটি রূপেরই কথা বলা আছে। ঈশ্বর সাকারও না, নিরাকারও না ; তিনি চিন্তার অতীত একটা সত্ত্বা। ঈশ্বর কোন পাঁচতলা, সাততলা, দশতলার উপরে পাপপুণ্যের ক্যালকুলেটর হাতে নিয়ে আরামচেয়ারে বসে নেই, তিনি সর্বত্র বিরাজিত, প্রত্যেকটি জীবের হৃদয়ে বিরাজিত, প্রত্যেকটি বস্তুতে বিরাজিত।
দ্বে বাব ব্রহ্মণো রূপে মূর্তং চৈবামূর্তং
চ মর্ত্যং চামৃতং চ স্থিতং চ যচ্চ সচ্চ ত্যচ্চ।।
(বৃহদারণ্যক উপনিষদ:২.৩.১)
"ব্রহ্মের দুইটি রূপ, মূর্ত(মূর্তিমান) ও অমূর্ত(অমূর্তিমান), মর্ত্য ও অমৃত, স্থিতিশীল ও গতিশীল, সৎ (সত্তাশীল) ও ত্যৎ (অব্যক্ত)।"
ভক্তকবি রজনীকান্ত সেন ঈশ্বরের মূর্ত-অমূর্ত, অরূপ-সরূপ, সগুণ নির্গুণ,দয়াল-ভয়াল সহ বিবিধ পরস্পর বিরোধী ভাবের একত্র সম্মিলন তাঁর একটি ব্রহ্মসংগীতে অত্যন্ত সুন্দর করে বর্ণনা করেছেন।
"তুমি, অরূপ সরূপ, সগুণ নির্গুণ,
দয়াল ভয়াল, হরি হে; -
আমি কিবা বুঝি, আমি কিবা জানি,
আমি কেন ভেবে মরি হে।"
একাধারে জগতের বিবিধ ভাবের সাথে যুক্ত এবং এর বিপরীতে সকল ভাবের অতীত, চিন্তার অতীত পরমেশ্বরকে নিরাকারভাবে উপাসনা করতে পারি। নিরাকারভাবে উপাসনায় প্রধানত ওঙ্কারকে অবলম্বন করেই পরমেশ্বরের পথে অগ্রসর হতে হয়। তেমনি সাকারভাবেও বিভিন্ন রূপ এবং প্রতিমাকে অবলম্বন করে ঈশ্বরের পথে অগ্রসর হতে পারি। সাকার পথটি তুলনামূলক সহজ। নিরাকার পথটি বেশ কষ্টসাধ্য। শাস্ত্রে বিভিন্ন অপচনশীল কৃত্রিম উপাদানে দেবপ্রতিমা তৈরিতে নিষেধ করা হয়েছে। পক্ষান্তরে কি কি প্রকৃতিজাত উপাদানে প্রতিমা তৈরি হবে তাও সুস্পষ্টভাবে বেদ, শ্রীমদ্ভাগবত সহ বিভিন্ন শাস্ত্রে নির্দেশনা দেয়া আছে। আমাদের উচিত সেই নির্দেশনা অনুসরণ করেই দেববিগ্রহাদি তৈরি করা।
শৈলী দারুময়ী লৌহী লেপ্যা লেখ্যা চ সৈকতী।
মনোময়ী মণিময়ী প্রতিমাষ্টবিধা স্মৃতা।।
(ভাগবত:১১.২৭.১২)
"আমার পূজা অষ্টবিধ উপকরণে নির্মিত যে কোন প্রতিমায় বিধেয়। এ অষ্টবিধ উপকরণ হল: পাথর, কাঠ,ধাতু, মাটি, চিত্রপট, বালুকা,মনোময়ী, মণিময়ী।"
ভগবানের পূজার প্রতিমা এবং বিগ্রহ কোন প্রাকৃতিক উপাদানে হতে হবে। সেই প্রাকৃতিক উপাদানটি বিভিন্ন প্রকারের শিলা বা পাথরের হতে পারে। পাথরটি খোদাই করে প্রতিমাও তৈরি করে যেমন পূজা করা যায় ; তেমনি নারায়ণ শিলা, গিরি গোবর্ধন শীলা অথবা বাণলিঙ্গের মত প্রকৃতিতে প্রাপ্তরূপেই পূজা করা যেতে পারে। কাঠের বিগ্রহকে দারুবিগ্রহ বলে। বিভিন্ন কাঠে বিগ্রহাদি তৈরি হয়, এরমধ্যে চন্দন কাঠের বিগ্রহ অন্যতম। পুরির জগন্নাথ, সুভদ্রা, বলভদ্র এবং তাঁদের সাথে সুদর্শন বিগ্রহ নিমকাঠে তৈরি হয়। বাংলায় সেই পরম্পরা অনুসরণ করে জগন্নাথ বিগ্রহ সহ অধিকাংশ বৈষ্ণব মন্দিরের বিগ্রহাদি নিমকাঠের তৈরি। এদের মধ্যে বিষ্ণু, শ্রীকৃষ্ণ এবং শ্রীচৈতন্য, শ্রীনিত্যানন্দ বিগ্রহ অন্যতম। জগন্নাথ বিগ্রহ কাঠের হওয়ায়, সেই বিগ্রহকে 'দারুব্রহ্ম' বলা হয়। সোনা, কাসা, পিতল, তামা সহ অধিকাংশ ধাতুতেই দেববিগ্রহ তৈরি হয়। এর মধ্যে সৌন্দর্য এবং দীর্ঘস্থায়ীত্বের জন্যে অষ্টধাতু নির্মিত বিগ্রহ অন্যতম। বাংলার অধিকাংশ সম্ভ্রান্ত পরিবারে অষ্টধাতুর রাধাকৃষ্ণ বা লক্ষ্মীনারায়ণ বিগ্রহ পূজিত হতে দেখা যায়। শাস্ত্রে বর্ণিত প্রতিমা তৈরির অষ্ট উপাদানের মধ্যে অন্যতম সহজলভ্য উপাদান হল মাটির তৈরি মৃন্ময়ী প্রতিমা। বাংলায় প্রধান উৎসব দুর্গাপূজা, কালীপূজা, সরস্বতী পূজা সহ অধিকাংশ পূজাতেই মৃন্ময়ী প্রতিমা পূজিত হয়। শ্রীচণ্ডীতেও প্রতিমাতে সমাধি বৈশ্য এবং রাজা সুরথ মাটির মৃন্ময়ী প্রতিমাতে দেবীকে পূজা করেছিলেন।
স চ বৈশ্যস্তপস্তেপে দেবীসূক্তং পরং জপন্।
তৌ তস্মিন্ পুলিনে দেব্যাঃ কৃত্বা মূর্তিং মহীমহীম্।।
(শ্রীচণ্ডী:১৩.১০)
"রাজা সুরথ ও সমাধি বৈশ্য জগন্মাতার দর্শন লাভমানসে নদীতীরে অবস্থান করে শ্রেষ্ঠ দেবীসূক্ত পাঠ ও অনুধ্যান করতে করতে তপস্যারত হলেন। তাঁরা উভয়ে সেই নদীতটে দুর্গাদেবীর মৃন্ময়ী প্রতিমা নির্মাণ করলেন।"
শ্রীচণ্ডীতে মৃন্ময়ী প্রতিমাতে সমাধি বৈশ্য এবং রাজা সুরথ যে পূজা করেছিলেন। আজও সেই অবিছিন্ন পরম্পরায় দেবীকে মাটির মৃন্ময়ী প্রতিমাতেই আরাধনা করা হয়। আমাদের ঐতিহ্য এবং উৎসবের কোন উপাদানই নবীন নয়; বহু চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আজও বহমান। আলেখ্য চিত্রপটও অত্যন্ত সহজলভ্য; তাই অত্যন্ত জনপ্রিয়। সমুদ্রের বালুকাতেও শিবলিঙ্গ সহ বিবিধ প্রতিমা তৈরি করে পূজা করা যায়। পূর্বে বিভিন্ন রাজাগণ মণিমাণিক্যের দেববিগ্রহ স্থাপন করে পূজা করতেন। এই সাতটি অন্য একটি উপাদান হল মনোময়ী বিগ্রহ। অর্থাৎ সাতটি উপাদানে যেমন ভগবদবিগ্রহাদি তৈরি করে সাকার মূর্তিতে বিবিধ উপাচারে তাঁর উপাসনা করতে পারি।তেমনি সম্পূর্ণ হৃদয়ের শুদ্ধ ভাবকে অবলম্বন করে হৃদয়মণ্ডলে পরমেশ্বরের প্রতিমা তৈরি করে তাঁর উপাসনা করতে পারি। পরমেশ্বর মূর্তমান, অমূর্তমান সকল ভাবে এবং স্বরূপেই বিরাজিত। শ্রীমদ্ভাগবতে বর্ণিত প্রতিমার উপাদানগুলোর উপাদানগুলো আমরা শুক্ল যজুর্বেদেও পাই। যজ্ঞ বলতে বর্তমানে আমরা আগুন জ্বালিয়ে তাতে হবি সমর্পণকেই বুঝি। কিন্তু যজ্ঞের অর্থ আরও ব্যাপক, ভগবানকে উপাসনা এবং তাঁর সন্তুষ্টির জন্য যে কর্ম তাকেও যজ্ঞ বলে। শ্রীমদভগবদগীতার চতুর্থ অধ্যায়েও জ্ঞানযজ্ঞ, দানযজ্ঞ, দ্রব্যযজ্ঞ সহ বিবিধ প্রকারের যজ্ঞের সম্পর্কে বলা হয়েছে। শুক্ল যজুর্বেদ সংহিতাতেও পাথর, মাটি, পাহাড়, বৃক্ষ, বিবিধ ধাতুর দ্বারা যজ্ঞ সুসম্পন্ন করার কথা সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে।
অশ্মা চ মে মৃত্তিকা চ মে গিরয়শ্চ মে পর্বতাশ্চ
মে সিকতাশ্চ মে বনস্পতয়শ্চ মে হিরণ্যং
চ মেঽযশ্চ মে শ্যামং চ মে লোহং চ মে সীসং
চ মে ত্রপু চ মে যজ্ঞেন কল্পতাম্।।
(শুক্ল যজুর্বেদ সংহিতা: ১৮.১৩)
"প্রস্তর, মৃত্তিকা, গিরি, পর্বত, বালুকা,বৃক্ষ-বনস্পতি সুবর্ণ, রৌপ্য, তাম্র, লৌহ, সীসা, ত্রপু(রঙ্গ বা রাং) -এগুলোর দ্বারা আমার যজ্ঞ সুসম্পন্ন হোক।"
কিন্তু বর্তমানে ককশিট, ফাইবার সহ এমন অনেক কৃত্রিম উপাদানে প্রতিমা তৈরি করা হয় যা, জলে বিসর্জিত হলেও জলের সাথে মিশে যায় না। এ সকল কৃত্রিম উপাদানের তৈরি প্রতিমায় পূজা অশাস্ত্রীয়।
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।