জীবন চলতে খুব বেশি কিছুর প্রয়োজন নেই। অতিরিক্ত ভোগের আকাঙ্ক্ষা আমাদের জীবনের তৃষ্ণাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। ভোগাসক্তি একটি জাজ্জ্বল্যমান অগ্নিকুণ্ডের মত। এ কুণ্ডে যত ভোগরূপ ঘৃতের আহুতি দিব ; ততই ভোগের আকাঙ্ক্ষা বেড়ে চলবে হুহু করে। আমাদের প্রতিনিয়ত চাই আর চাই। এ চাওয়ার যেন আপাতদৃষ্টিতে পরিসমাপ্তি নেই। আমরা কাউকে বসতে বললে শুয়ে থাকতে চাই, শুয়ে থাকতে বললে চিরস্থায়ী বসবাসের বন্দোবস্ত করতে চাই। সময় থাকতেই এ চাওয়া পাওয়ার ঘোড়াকে যথাসম্ভব রাশ টেনে ধরা প্রয়োজন। কিন্তু আমরা সেই ঘোড়ার লাগামকে সময় মত অধিকাংশ মানুষই টেনে ধরতে পারি না।আমাদের সর্বদা মনে রাখা প্রয়োজন, এ বিশ্বচরাচরে সকল কিছুই ভগবানের ৷ তিনিই এ জগতের পরিচালনারূপ নিমিত্ত কারণ এবং তিনিই জগতের জড় চেতন সর্বভূতে বিরাজিত উপাদান কারণ। আমাদের উচিত জীবন ধারণের জন্য যতটুকু প্রয়োজনীয়, শুধু তাই গ্রহণ করা। ত্যাগের সাথে ভোগ করা। কখনই অন্যের ধনে লোভ করা উচিত নয় ৷
ঈশাবাস্যমিদং সর্বং যৎ কিঞ্চ জগত্যাং জগৎ ৷
তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা মা গৃধঃ কস্যস্বিদ্ ধনম্ ৷৷
"এই গতিশীল বিশ্বে যাহা কিছু চলমান বস্তু আছে তা ঈশ্বরের বাসের নিমিত্ত মনে করবে। ঈশ্বর দ্বারা জগতের বস্তুসমূহ আচ্ছাদিত মনে করবে। ত্যাগের সহত ভোগ করবে; কারো ধনে লোভ করবে না।"
শ্রীশঙ্করাচার্য তাঁর জগদ্বিখ্যাত 'মোহমুদগর' গ্রন্থে মানব জীবনের ক্ষণস্থায়ীত্বকে স্মরণ করে দিয়ে অতিরিক্ত ধন সম্পদের, জনসম্পদের এবং যৌবনের গর্ব করতে সুস্পষ্টভাবে নিষেধ করেছেন।আমরা যখন 'আমি আমি' এবং 'আমার আমার' বলি ভগবান স্মিত হাসি দেন। এই যে আমাদের এত গর্বের ধন মহাকাল নিমেষের মধ্যেই তা যে কোন সময়েই হরণ করে নিয়ে যেতে পারে। এরপরেও আমাদের হুশ হয় না। আমরা বেহুশ থাকি।যখন কোন হাসপাতালে অসুস্থ রোগীদের দুঃখদুর্দশা দেখি তখন আমাদের মনে কিছুটা সাময়িক ভাবান্তর আসে। হিংসা, বিদ্বেষ ঈর্ষা কিছুটা ভুলে যাই। একই ঘটনা শ্মশানেক্ষেত্রে গেলেও হয়। সাধের এবং অত্যন্ত আদরের শরীরটি মৃতশব হয়ে যাবার পরে সেই শরীরটিকে অগ্নিতে সমর্পণ করা হয়। তখন জীর্ণবস্ত্রাদির মত অসার শরীরটি যখন আগুনে পুরে যেতে থাকে; তখনও আমাদের মাঝে কিছুটা সময়ের জন্যে হলেও সাত্ত্বিক ভাবান্তর আসে। এ ভাবান্তরকে শাস্ত্রে 'শ্মশানবৈরাগ্য' বলে। তাই আমাদের মায়াময় এই সংসারের সকল আসক্তি থেকে নিজেকে প্রত্যাহৃত করে আস্তে আস্তে ব্রহ্মপদের শরণে যাওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন।
মা কুরু ধনজনযৌবনগর্বং
হরতি নিমেষাৎ কালঃ সর্বম্।
মায়াময়মিদমখিলং হিত্বা
ব্রহ্মপদং প্রবিশাশু বিদিত্বা।।
(মোহমুদগর :৩)
"হে মানব কখনো অতিরিক্ত ধন,জন এবং যৌবনের গর্ব করো না; মহাকাল নিমেষের মধ্যেই তোমার এ সকল গর্বের বস্তু হরণ করে নিয়ে যেতে পারে। তাই মায়াময় এই সংসারের সকল আসক্তি থেকে নিজেকে প্রত্যাহৃত করে আস্তে আস্তে ব্রহ্মপদের শরণে যত্নবান হও।"
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।