১২০৪ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গরাজ লক্ষ্মণ সেনকে পরাজয়ের মাধ্যমে বাংলায় বিদেশি তুর্কী সাম্রাজ্যবাদী শাসন শুরু হয়। এই বিদেশীয় আততায়ীরা এই ভূখণ্ডের উপরে তাদের করায়ত্ব বজায় রাখতে প্রথমেই এদেশীয় পবিত্র সকল বিশ্বাস এবং শ্রদ্ধাস্পদ বিষয়কে আক্রমণে কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করে। এদেশীয় মানুষের যে সকল বস্তুই ছিল শ্রদ্ধার, তা সকলেই তাদের কাছে পরিহাস এবং ঘৃণার বস্তুতে পরিণত হয়। এর অসংখ্য উদাহরণ দেয়া যায়।ভারতবর্ষের হিন্দু সমাজের সবচেয়ে পরম শ্রদ্ধেয় হলেন সাধু, সন্ন্যাসীবৃন্দ; এবং সাধু, সন্ন্যাসীদের চেনার চিহ্নই হলো তাদের হাতে রাখা দণ্ডকমণ্ডলু। সন্ন্যাসীদের হাতে থাকা পবিত্র কমণ্ডলুই তুর্কিরা প্রথম মলত্যাগ করে শৌচকার্যে ব্যবহার শুরু করে শুধুমাত্র এদেশীয় বিশ্বাস এবং পরম্পরাগত ভাবাবেগকে আঘাত করার জন্যে।কমণ্ডলুর উপরের ধরণী অংশটা বাদ দিলেই এটা বর্তমানে আমাদের ব্যবহৃত বদনা হয়ে যায়, যা তুর্কিদের দেখানো পথে আমি আপনি সকলেই টয়লেটে প্রতিনিয়ত নিজের অজান্তেই ব্যবহার করে চলছি!এবং সাথে সাথে ঋষিদেরও প্রতিনিয়ত অপমান করে চলছি।
এদেশীয় পরম্পরাগত ভাবাবেগ এবং বিশ্বাসকে আঘাতের প্রধান লক্ষ্য বস্তু ছিল বিদেশি সাম্রাজ্যবাদীরা। তাদের আক্রমণের প্রথমেই শিকার হয় মানুষের বিশ্বাস এবং শ্রদ্ধার প্রতীক বিভিন্ন দেবমমন্দিরগুলো। এ মন্দিরগুলোকে তারা বিভিন্ন সময় আক্রমণ করেছে ক্ষতবিক্ষত করেছে। এ কারণে ভারতবর্ষের ইতিহাসে দেখা যায়, অনেক মন্দিরই বিভিন্ন সময়ে স্থানান্তরিত হতে হয়েছে। আমরা যদি চট্টগ্রামের পুরাতন ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখি, চট্টগ্রামের স্থানীয়দের কতটা নির্দয়ভাবে ধর্মান্তরিত করা হয়েছে। সপ্তদশ শতকের প্রখ্যাত কবি মুহাম্মদ খান কর্তৃক আনুমানিক ১৬৪৬ খ্রিস্টাব্দে রচিত ‘মক্তুল হোসেন’ কাব্যের শুরুতেই আমরা দেখতে পাই চট্টগ্রামের স্থানীয় মানুষদের কিভাবে ধর্মান্তরিত করা হয়েছে।
কদলখান গাজী তার এগারো জন বন্ধু-দরবেশের সাহায্যে চট্টগ্রামে ইসলাম প্রচার করেন। চট্টল বিজেতা কদল খান গাজী সর্ম্পকে বিস্তারিত কোন তথ্য পাওয়া যায় না। সপ্তদশ শতকের প্রখ্যাত কবি মুহাম্মদ খাঁ রচিত ‘মক্তুল হোসেন’ গ্রন্থ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের সমন্বয়ে গবেষকরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, ১৩৪০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে সুফি কদল খান গাজী এগারোজন বন্ধু দরবেশের সহযোগিতায় স্থানীয়দের পরাজিত করে চট্টগ্রাম অধিকার করে তা সুলতান ফখরুদ্দীন মোবারক শাহের দখলদারিত্বের অন্তর্ভুক্ত করেন।অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে কদলখান গাজী ছিলেন ফখরুদ্দিন মোবারক শাহের সেনাপতি। মতান্তরে সুফি ভাবাদর্শী কদল খান গাজী ধর্ম প্রচারের আশায় নিজের উদ্যোগেই তার শিষ্যদের নিয়ে স্থানীয় চট্টলবাসীদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হন এবং ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ তাকে সৈন্যদল দিয়ে সাহায্য করেন। এ দু'টি তথ্যের মধ্যে যে তথটিই সত্য হোক না কেন; একথা ঐতিহাসিক সত্য যে কদল খান গাজীর মাধ্যমেই সর্বপ্রথম চট্টল বিজিত হয় তুর্কী সাম্রাজ্যবাদীদের দ্বারা । মক্তুল হোসেন গ্রন্থে উল্লেখ আছে:
"এক মনে প্রণাম করম বারে বার।
কদলখান গজী পীর ত্রিভূবনের সার ।।
যাঁর রণে পড়িল অক্ষয় রিপুদল।
ভএ কেহ মজ্জি সমুদ্রের তল ।।
একসর মহিম হইল প্রাণহীন।
রিপুজিনি চাটি গ্রাম কৈলা নিজাধীন ।।
বৃক্ষডালে বসিলেক কাফিরের গণ।
সেই বৃক্ষ ছেদি সবে করিলা নিধন ।।
তান একাদশ মিত্র করম প্রণাম।
পুস্তক বাড়এ হেতু না লেখিলু নাম।।
তান একাদশ মিত্র জিনিয়া চাটিগ্রাম।
মুসলমান কৈলা চাটিগ্রাম অনুপাম ।।"
কতটা নির্মমতার আশ্রয় নিয়ে চট্টগ্রামকে ধর্মান্তরিত করা হয়েছে, তা সেই সময়ের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখতে পাই। আরববীয়, তুর্কি পাঠান শাসকদের ইতিহাসের সংরক্ষণে একটি অত্যন্ত পজেটিভ বিষয় ছিল, তা হল নিজদের কর্মকাণ্ড লিখে রাখা। সেকালে তারা যা নৃসংসতা করেছে, তা সকলই তারা অকপটে স্বীকার করে গিয়েছেন। তৎকালীন সময়ে বিষয়টি ছিল তাদের কাছে অত্যন্ত গর্বের। প্রায় সকলেরই আরবি, ফার্সি বা স্থানীয় ভাষায় জীবনী লেখা আছে। এ গ্রন্থগুলোতে সকল তথ্য লিপিবদ্ধ করা আছে যে, কিভাবে তারা বিভিন্ন এদেশীয় মন্দিরগুলোকে ধ্বংস করেছে। কত মানুষকে হত্যা করেছে ইত্যাদি। সেসময়ে বিষয়টি তাদের কাছে গর্বের থাকলেও, তারা হয়ত কখনও কল্পনা করেনি আজকের পৃথিবীর। বৈশ্বিক সকল জাতির একে অন্যের কাছাকাছি আসবে। বৈশ্বিক শান্তি প্রতিষ্ঠায় জগতের সকল জাতিগোষ্ঠীকে নিয়ে 'জাতিসংঘ' নামে একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান হবে। মানবতার প্রশ্নে, গণহত্যার প্রশ্নে জগতের সকল জাতিগোষ্ঠীকেই জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। মানুষ ইচ্ছামত কোন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ধ্বংস কাজ করতে পারবে না। বিষয়টি তারা হয়তো কল্পনাও করতে পারিনে। কল্পনা করতে পারলে তারা হয়ত তাদের বিভিন্ন নৃশংস বর্বরোচিত ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের কথা গৌরবের ভাষায় লিখে রাখতেন না।
ভারতবর্ষের অধিকাংশ নগর সেই নগরের উপাস্য কোন কুলদেবতা বা কুলদেবীর নামে নামাঙ্কিত। তাই প্রত্যেকটি স্থানের সাথেই একজন দেবতা বিশেষ করে দেবীর নাম পাওয়া যায়। যেমন ঢাকার নামের সাথে যুক্ত দেবী ঢাকেশ্বরী; তেমনি চট্টগ্রামের সাথে চট্টেশ্বরী, কোলকাতার সাথে কালীঘাট, যশোরের সাথে যশোরেশ্বরী ইত্যাদি। অনুসারে স্থাপি অবশ্য চট্টেশ্বরী মন্দিরে অপর একটি দেবীমূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হয়। বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী তুর্কি শাসকরা কোন নগরকে জয় করে সর্বপ্রথমে তারা সেই শহরের আরাধ্য কুলদেবতা বা দেববিগ্রহাদি ধ্বংস করে মানুষের মধ্যে প্রচণ্ড ভীতি স্থাপন করতেন। চট্টগ্রামে প্রাচীন ইতিহাসেও ঠিক একই ঘটনাটি ঘটে। মধ্যযুগের কবি মােহাম্মদ খান রচিত 'মক্তুল হােসেন' কাব্যে স্থানীয়দের নির্মমভাবে ধর্মান্তরিত করার সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ পাওয়া যায়। সেই কাব্যের শুরুতেই বলা আছে জঙ্গী পীর কদল খান গাজীর সহযােগীরা চট্টগ্রাম নগর করায়ত্ব করে সর্বপ্রথম দেবী চট্টেশ্বরীর বিগ্রহাদি ধ্বংস করে চট্টগ্রামের অধিবাসীদের ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করে।
তান এক মিত্রে বধিলেক চাটেশ্বরী।
মুসলমান কৈল সব চাটিগ্রাম পুরী ॥
( সুকুমার সেন, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, পৃ. ৬২৬)
চট্টেশ্বরী দেবী তৎকালে সীতাকুণ্ড চন্দ্রনাথ তীর্থে অবস্থিত ছিল।দেবী পুরাণে চৈত্র মাহাত্ম্যে স্বয়ম্ভুরহস্য কথনে চণ্ডিক খণ্ডে বলা আছে, চন্দ্রশেখর পর্বত স্থিত চট্টেশ্বরী অন্নপূর্ণারূপে সর্বদা সাধুদের রক্ষা এবং দুষ্টের বিনাশে করেন।কদল খান গাজী এবং তার এগারোজন সহযোগী মিলে যখন চট্টেশ্বরী দেবীর বিগ্রহ ধ্বংসের পরে পরবর্তীতে কোন সময়ে চট্টেশ্বরী দেবীর বিগ্রহ চট্টগ্রাম শহরের বর্তমান স্থানে স্থাপিত হয়। বর্তমান চট্টেশ্বরী অঞ্চলটি সে সময়ে ছিল নির্জন ঘন জঙ্গলে পূর্ণ। এ কারণেই বিভিন্ন পুরাণ এবং তন্ত্রে চট্টেশ্বরী দেবীর বর্ণনা চন্দ্রনাথ তীর্থে বর্ণিত হলেও, বর্তমানে দেবীতীর্থটি পাওয়া যায় চট্টগ্রাম শহরের কেন্দ্রস্থলে।
যত্র চট্টেশ্বরী দেবী চান্ন পূর্ণা বভূবহ।
দুষ্টানাং প্রাণমাশায় সাধূনাং রক্ষণায় চ।
লিঙ্গরূপং সমাস্থায় শ্রীচণ্ডশেখরে বসন্ ॥
বিরূপাক্ষে কদাদেবাে ভবান্যাচ ভূতেশ্বরঃ।
কদাচ চম্পকারণ্যে কদাচ বাড়বানলে ॥
কদা মন্দাকিনীগতঃ সচ দেবস্মরান্তকঃ।
বভ্রাম কাননে রম্যে লবণাম্বুসমীপতঃ ॥
"সেই চন্দ্রশেখর পর্বত স্থিত চট্টেশ্বরী অন্নপূর্ণারূপে সাধুদের রক্ষা এবং দুষ্টের বিনাশে; কখনও বিরুপাক্ষে , কখনও চম্পকারণ্যে, কখনো বাড়বানলে, কখনো মন্দাকিনীতে, কোন কোন সময়ে লবনাম্বু সমীপবর্তী রম্যকাননে ভগবান ভূতেশ্বর ষ্মরান্তকারী শিব লিঙ্গমূর্তিতে দেবী পার্বতীর সাথে বিরাজ করেন।"
চট্টগ্রাম জেলার বোয়ালখালি থানার সরোয়াতলি গ্রামের অধিবাসী সাধক রামসুন্দর দেবশর্মণ ছিলেন চট্টেশ্বরী দেবীর একজন নিষ্ঠাবান সাধক। ব্রিটিশ আমলে চট্টগ্রামের তৎকালীন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট কবি নবীন চন্দ্র সেন দেবীর সেবাপুজোর জন্য রামসুন্দর দেবশর্মণকে একটি বড় অঙ্কের অর্থসাহায্য প্রদান করেছিলেন।১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকহানাদার বাহিনী ও তাদের সহযোগী রাজাকারদের দ্বারা পবিত্র এ মন্দিরটি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে কালের পরিক্রমায় আজও স্বমহিমায় বর্তমান।
বাংলায় সুলতান ফখরুদ্দীন মোবারক শাহের দখলদারিত্বের ১৩৪০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে সুফি কদল খান গাজী এগারোজন বন্ধু দরবেশের সহযোগিতায় স্থানীয়দের পরাজিত করে চট্টগ্রাম অধিকার করে তা অন্তর্ভুক্ত করে তারা প্রথমে চট্টেশ্বরী দেবীর বিগ্রহটি ধ্বংস করেন- "বধিলেক চাটেশ্বরী"। এরপরে স্থানীয় মানুষদের জোরকরে ধর্মান্তরিত করেন- "মুসলমান কৈল সব চাটিগ্রাম পুরী"। সাধারণ মানুষ এদের অত্যাচার থেকে বাঁচতে যখন গাছেল ডালে উঠেও বাঁচতে পারেননি। যারা গাছের ডালে গিয়ে বসেছে, তাদেরও বৃক্ষছেদন করে নৃশংসভাবে নিধন করা হয়।
"বৃক্ষডালে বসিলেক কাফিরের গণ।
সেই বৃক্ষ ছেদি সবে করিলা নিধন ।"
চট্টগ্রামের স্থানীয় মানুষদের সাথে সকল যিনি করেছেন, তার সম্পর্কে বাংলাদেশের জাতীয় জ্ঞানকোষ বাংলাপিডিয়ায় সংক্ষিপ্তভাবে হলেও কদল খান গাজীর নৃশংসতার বিবরণের সমর্থন মেলে। সেখানে বলা আছে:
"কদল খান গাজী (১৪শ শতক) সুলতান ফখরউদ্দীন মুবারক শাহের (১৩৩৮-১৩৪৯) সেনাপতি বলে কথিত। চট্টলা (চট্টগ্রাম) বিজয়কালে হাজী খলিল ও বদর আলম তাঁর সঙ্গী ছিলেন। তাঁরা চট্টগ্রামে ইসলাম প্রচারে প্রধান ভূমিকা পালন করেন। চট্টগ্রাম শহরের উত্তর দিকে কদল খান গাজীর মাযার আছে। স্থানীয় জনগণের মধ্যে তিনি ‘কাতাল’ বা ‘কাত্তাল পীর’ নামে পরিচিত। এ থেকে ওই স্থানের নাম হয় কাতালগঞ্জ। সম্ভবত কদল খান মগদের সঙ্গে যুদ্ধে বহু শত্রুর শিরশ্ছেদ করে ‘কতল’ (অর্থ শিরশ্ছেদ) আখ্যা পান এবং ‘কতল’ আঞ্চলিক উচ্চারণে হয়েছে ‘কাতাল’।"
কদল খান গাজী পীর স্থানীয় এত মানুষকে শিরোচ্ছেদ করে নৃশংসভাবে হত্যা করেছিলেন যে, আজও তার নামের সাথে 'কতল’ বা শিরশ্ছেদ শব্দটি যুক্ত হয়ে তিনি 'কাতাল পীর' নামে খ্যাত। যে স্থানটিতে তার মাযার অবস্থিত, সেই স্থানের নাম 'কাতালগঞ্জ'।
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।
২য় পর্বের লিঙ্ক ঃ চট্টগ্রামের ইতিহাস সংস্কৃতির পুনর্পাঠ- ২ ।