-->

ধর্ম নির্ণয়ে বেদই একমাত্র প্রমাণ; পুরাণ এবং স্মৃতি সহায়ক মাত্র

বর্তমানে সনাতন ধর্মাবলম্বী কিছু ব্যক্তি প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদকে পাশ কাটিয়ে শুধু পৌরাণিক গ্রন্থ অথবা বিভিন্ন বাবাগুরুদের লেখা ছড়ার বই, গ...

রমেশচন্দ্র মজুমদারের হাতেই, পূর্ণাঙ্গতা পায় বাঙালির প্রকৃত ইতিহাস।

রমেশচন্দ্র মজুমদারের হাতেই, পূর্ণাঙ্গতা পায় বাঙালির প্রকৃত ইতিহাস।
১৮৩৫ সালে ব্রিটিশরা ভারতবর্ষের নিজস্ব পরম্পরাগত শিক্ষা ব্যবস্থাকে নিষিদ্ধ করে পাশ্চাত্য ভাষায় এবং পাশ্চাত্য রীতিনীতিতে এদেশীয়দের জন্যে শিক্ষা বাধ্যতামূলকভাবে প্রবর্তন করে। শিক্ষা ব্যাবস্থাকে বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী শিক্ষা ব্যবস্থায় রূপান্তরিত করায়, এর যেমন ইংরেজি শিক্ষা এবং পাশ্চাত্য শিক্ষার সাথে যোগাযোগ সহ কিছু সুফল ছিল; পক্ষান্তরে তেমনি ছিল ভয়াবহ কুফল। বিদেশি ব্রিটিশ শাসক এদেশীয় ইতিহাস এবং দর্শনকে পরম্পরাহীনভাবে তাদের নিজস্ব ভঙ্গিতে তাদের মত করে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ শুরু করে। তখন থেকেই এদেশীয় চিন্তা-চেতনা, ইতিহাস এবং দর্শনের বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসকদের পক্ষ থেকে যে ষড়যন্ত্রের বুদ্ধিদীপ্ত জাল বিছানো হয় সেই বৌদ্ধিক পরাধীন চিন্তার জাল আজও অবিচ্ছিন্ন বহমান। এ ষড়যন্ত্রকারীদের অন্যতম নায়ক হলেন লর্ড ম্যাকলে। তিনি চেয়েছিলেন ভারতবর্ষের জনসাধারণ শুধু নামেই থাকবে ভারতীয়, কিন্তু তার চাল-চলন, আচার-ব্যাবহার সব কিছুই থাকবে ব্রিটিশের মত। ভারতীয়রা থাকবে ব্রিটিশের পোষা কুকুরছানার মত। ইচ্ছে হলে আদর করবে, আর না হলে লাথি দিয়ে বের করে দিবে।

ব্রিটিশদের সত্যি অনেক ভবিষ্যত দৃষ্টি ছিল
বলতে হবে; কারণ তারা যা চেয়েছে পরবর্তীতে তাই অনেকটা হয়েছে এদেশীয় ইতিহাস চর্চা নিয়ে। সীমাহীন মিথ্যাচার এবং তথ্যসন্ত্রাস চলছে এদেশীয় নিজস্ব ইতিহাস চর্চাকে ঘিরে। এ ইতিহাসের ঘুর্ণিপাকে পরে প্রকৃত ইতিহাসের খোঁজে এদেশীয়রা দিন-রাত্রি পথ হাতরে বেড়িয়েছে বহুকাল। ইতিহাস নিয়ে সীমাহীন মিথ্যাচারের অভিঘাতে এদেশীয়রা আর্য-অনার্য বিভাজন করে নিজেরাই নিজদের ঘৃণা করতে শুরু করে।এমনি প্রেক্ষাপটে যিনি না থাকলে ভারতবর্ষের ইতিহাসের আরো সহস্র সহস্র বিকৃতি ঘটত, যিনি বাঙালির ইতিহাস চর্চাকে অনেকটাই পূর্ণাবয়ব দিয়েছেন, যিনি সাম্রাজ্যবাদী দখলদারদের ইতিহাস চর্চা নামক মিথ্যা প্রোপাগান্ডাগুলির বিরুদ্ধে যথোপযুক্ত জবাব দিয়েছেন; তিনি হলেন প্রাতঃস্মরণীয় ইতিহাসবিদ রমেশচন্দ্র মজুমদার।১৮৮৮ সালের ৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশের গোপালগঞ্জ জেলার মুকসুদপুর উপজেলার খান্দারপাড় নামক গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত শিক্ষানুরাগী পরিবারে তিনি জন্মগ্রহন করেন। তাঁর বাবার নাম ছিলো হলধর মজুমদার এবং রত্নগর্ভা মায়ের নাম ছিলো বিন্দুমুখী।
ইতিহাসবিদ রমেশচন্দ্র মজুমদার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম এবং আজ পর্যন্ত একমাত্র হিন্দু ধর্মাবলম্বী উপাচার্য। তিনি জগন্নাথ হলেরও প্রভোস্ট ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার বাড়িতেই এসেছিলেন। নির্মোহ ইতিহাস চর্চাই তাকে অমরত্ব দান করেছে।
রমেশচন্দ্র মজুমদার ১৯১৪ সালের জুলাই মাসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগের প্রভাষক হিসেবে নিযুক্ত হন।
সদ্যগঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯২১ সালের জুলাই মাসে ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন।
১৯৩৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে নিযুক্ত হয়ে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত স্বপদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
১৯৫০ সালে তিনি ইন্ডোলজি কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হিসেবে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়ে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন।
১৯৫৫ সালে রমেশচন্দ্র মজুমদার নাগপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্ডোলজি কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেন।
১৯৫৮ থেকে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত তিনি আমেরিকার শিকাগো এবং পেনসেলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতীয় ইতিহাসের শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন।
বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ার জীবনে রমেশচন্দ্র মজুমদার এশিয়াটিক সোসাইটি (১৯৬৬-৬৮) ; বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের (১৯৬৮-৬৯) সভাপতি এবং কলকাতার ‘শেরিফ’ও (Sheriff) ছিলেন।
প্রকাশিত এবং সম্পাদিত গ্রন্থাবলি :
১৯২৪ সালে "Early History of Bengal " নামক তাঁর ছোট একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়।
১৯২৭ সালে তিনি "চম্পা" নামে ভিয়েতনাম অঞ্চলের রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের ওপরে একটি অনবদ্য গ্রন্থ রচনা করেন।
১৯৪৪ সালে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার ইতিহাস নিয়ে "Hindu Colonies in the Far East"গ্রন্থ রচনা করেন।
রমেশচন্দ্র মজুমদার তিন খন্ডে "বাংলাদেশের ইতিহাস" নামে সমগ্র বাংলার পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচনা করেন। প্রাচীন বাংলার উপরে সর্বশ্রেষ্ঠ এ গ্রন্থটির প্রথম খণ্ড ১৯৪৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিজস্ব অর্থায়নে প্রকাশ করে।বাংলার ইতিহাস রচনার আকর এ গ্রন্থটি তাকে অমর করে দিয়ে বিশ্বব্যাপী পন্ডিত মহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়। গ্রন্থটির প্রথম সংস্করণের ভূমিকায় তিনি বলেন, "প্রাচীন বাংলার ইতিহাস সম্বন্ধে কতকটা ধারণা করিতে পারিবেন। অবশ্য এই ইতিহাসের অতি সামান্যই আমরা জানি। কিন্তু এই গ্রন্থপাঠে যদি বাঙালীর মনে দেশের প্রাচীন গৌরব সম্বন্ধে ক্ষীণ ধারণাও জন্মে এবং বাঙালী জাতির অতীত ইতিহাস জানিবার জন্য কৌতুহল ও আগ্রহ বৃদ্ধি পায়, তাহা হইলেই আমার শ্রম সার্থক মনে করিব।"
ভারতীয় বিদ্যাভবন সিরিজের ১১ খণ্ডে রচিত "History and Culture of the Indian people " ছিল রমেশচন্দ্র মজুমদারের এক কালজয়ী কীর্তি।
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস তুলে ধরতে ১৯৫৭ সালে লিখেন The Sepoy Mutiny and the Revolt of 1857 (one volume, 1957) ;
এবং ১৯৬২- ৬৩ সালের মধ্যে তিন ভলিউমের লেখেন History of Freedom Movement in India (three volumes, 1962-63) নামক ৪টি বৃহৎ গ্রন্থ। অনন্য এ গ্রন্থগুলিতে তিনি ভারতীয় ইতিহাসের তথ্যপূর্ণ পুনর্গঠন করেন।
১৯৮০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি, সোমবার মহান ইতিহাসবিদ, জ্ঞানসাধক রমেশচন্দ্র মজুমদার মৃত্যুবরণ করেন। রেখে যান বাংলার ইতিহাস চর্চায় তাঁর নির্মোহ অক্ষয়কীর্তি।
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।
মন্তব্যগুলো দেখুনমন্তব্যগুলো লুকান🙁