আমার জীবনে কিছু অত্যন্ত জ্ঞানী ব্যক্তির সাহচর্য হয়েছে, এর মধ্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক সত্যজিৎ কুমার ভদ্র স্যার অন্যতম। ২০১৫ সালের ২৬ জানুয়ারি সরস্বতী পূজার আগের দিনে তার মৃত্যু হয়।আমি সেদিন ঢাকা ছিলাম। সংস্কৃত বিভাগের শিক্ষক লিটন মিত্র মোবাইলে কল করে স্যারের মৃত্যুর সংবাদটি আমাকে দেয়। প্রচণ্ড কষ্ট পাই, স্যারের মৃত্যুতে। সেদিনই সাথে সাথেই চট্টগ্রামে চলে আসি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের
অত্যন্ত স্বনামধন্য অধ্যাপক ছিলেন সত্যজিৎ কুমার ভদ্র স্যার। ২৬ জানুয়ারি, সোমবার দুপুর আড়াইটার দিকে নগরীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। সত্যজিৎ কুমার ভদ্র স্যার ১৯৭৪ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগে শিক্ষকতা পেশায় যোগদান করেন। ২০১০ সালে তিনি দূরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হন।স্যারের সাথে অসখ্য স্মৃতি জড়িয়ে আছে আমার। স্যার নিজে যেহেতু প্রচণ্ড জ্ঞানপিপাসু ছিলেন, তাই তিনি জ্ঞানের চর্চা এবং গবেষণাকে প্রচণ্ডভাবে অগ্রাধিকার দিতেন। আমার মনে পরে, ২০১২ সালে যেদিন আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যাললে শিক্ষকতা পেশায় যোগদান করি; সেদিনই বিকেলে স্যার বাসায় যাই। স্যার আমাদের দেখে প্রচণ্ড খুশি হয়ে সবাইকে মিলেমিশে ঐক্যবদ্ধভাবে থাকতে বলেন। নতুন সহকর্মী সবাইকেই বিভিন্ন প্রকারের প্রশ্ন করে বিভিন্ন বিষয় জানতে চান। এরই ধারাবাহিকতা তার সেল্ফ থেকে বোটানি বিষয় সংক্রান্ত একটি ইংরেজি বই বের করে সেই বইটি আমার সামনে মেলে ধরেন। বোটানির বইটি ইংরেজি হলেও, এর মধ্যে প্রচুর আয়ুর্বেদীয় কোটেশন ছিল। কোটেশনগুলো সংস্কৃত ভাষায় দেবনাগরী ভাষায় লেখা ছিল। তিনি আমাকে পড়ে অর্থ বলতে বললেন। আমি অনেকটা ভয়ে ভয়ে পড়ে, যথাসম্ভব সেই শ্লোকের অর্থ বললাম। স্যার খুব খুশী হলেন। সেই নিবিড় পরিচয় থেকে যতদিন বেঁচে ছিলেন বিভিন্ন বিষয়ে তার সাথে কথা হয়েছে।বিজ্ঞান, সাহিত্য, ধর্ম এবং দর্শন সহ সকল বিষয়েই তার অত্যন্ত আগ্রহ ছিল। আজ স্যার আমাদের মাঝে নেই পাঁচ বছর হল প্রায়। কিন্তু আজও বিভিন্ন প্রসঙ্গে প্রতিনিয়ত স্যারের কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই বিখ্যাত গানের দুটি লাইন:
"নয়নসমুখে তুমি নাই,
নয়নের মাঝখানে নিয়েছ যে ঠাঁই-আজি তাই
শ্যামলে শ্যামল তুমি, নীলিমায় নীল।
আমার নিখিল তোমাতে পেয়েছে তার অন্তরের মিল।"
দুরারোগ্য ক্যান্সার হওয়ায় খুব দ্রুতই যে সবার কাছে থেকে চলে যাবেন, এটা স্যার জানতেন। এ নিয়ে তার একটি মানসিক প্রস্তুতিও ছিল। শেষের কয়েক বছরের কথাবার্তা এবং আচরণে তা বোঝা যেত। তবে তিনি হয়ত আরও কিছুদিন বাঁচতে পারতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্র সহ সার্বিক পরিস্থিতির বর্তমান দশায় তিনি অত্যন্ত মর্মাহত ছিলেন।পালি ও সংস্কৃত বিভাগ ভেঙে আনুষ্ঠানিক ভাবে সংস্কৃত ও পালি দুটি আলাদা বিভাগে রূপান্তরিত হয় ২০১৩ সালে। সত্যজিৎ ভদ্র স্যারের স্ত্রী শান্তি রাণী হালদার নবগঠিত সংস্কৃত বিভাগের সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে শান্তি ম্যাডাম শূন্য থেকে সংস্কৃত বিভাগকে নতুন করে তৈরি করার যথাসাধ্য প্রচেষ্টা শুরু করেন। কিন্তু শান্তি ম্যাডামের এ প্রচেষ্টায় অনাকাঙ্ক্ষিত বিভিন্ন প্রকারের অহেতুক বাঁধা আসতে থাকে। সেই ঘটনাগুলো কুশীলব সকলেই ছিলেন শান্তি ম্যাডামের সরাসরি ছাত্রছাত্রীরা। বিষয়টি সত্যজিৎ ভদ্র স্যারকে অত্যন্ত মর্মাহত করে তোলে। একজন শিক্ষকের সাথে তার প্রত্যক্ষ ছাত্রছাত্রী কি করে এতটা বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে -এ বিষয়টি ভদ্র স্যার কোনক্রমেই মেনে নিতে পারছিলেন না। এমনই বিভিন্ন ঘটনাচক্রের অভিঘাতে, দেশের উচ্চশিক্ষার ভবিষ্যৎ নিয়ে তিনি হতাশ হয়ে পড়েছিলেন।