-->

ধর্ম নির্ণয়ে বেদই একমাত্র প্রমাণ; পুরাণ এবং স্মৃতি সহায়ক মাত্র

বর্তমানে সনাতন ধর্মাবলম্বী কিছু ব্যক্তি প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদকে পাশ কাটিয়ে শুধু পৌরাণিক গ্রন্থ অথবা বিভিন্ন বাবাগুরুদের লেখা ছড়ার বই, গ...

"একং সদ্বিপ্রা বহুধা বদন্তি"; বিভিন্ন রূপে জগতের আরাধ্য একজনই।

এক এবং অদ্বিতীয় ঈশ্বরের বিভিন্ন নাম এবং রূপের পূজা করি, উপাসনা করি আমরা। যত দেবদেবী প্রতিমা সকলই আদতে এক ব্রহ্মেরই বিভিন্ন রূপের প্রকাশ। কিন্তু আমরা দেখি যে বিভিন্ন পূজায়, এই ফুল দেয়া যাবে না, ঐ ফুল দেয়া যাবে না, এটা করা যাবে না, ওটা করা যাবে না; বলে শাস্ত্রীয় নির্দেশ। বিষয়টি ব্যক্তিগতভাবে অপছন্দের আমার। কিছুদিন আগে পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়িতে একটি লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দিরের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। সে মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে দেখতে পেলাম, ত্রিপুরা আদিবাসী সম্প্রদায়ের নারায়ণ পূজারী লাল ফুল এবং বেলপাতা দিয়ে সম্পূর্ণ নারায়ণ পূজাটি সমাপ্ত করলেন । বিষয়টি দেখে প্রথমে আমার আজন্ম সংস্কারে বাঁধে যে, বেলপাতা এবং লালফুল দিয়ে এ আবার কেমন নারায়ণ পূজা হচ্ছে!

"একং সদ্বিপ্রা বহুধা বদন্তি";  বিভিন্ন রূপে জগতের আরাধ্য একজনই।

পরক্ষণেই মনে হলো, সকল দেবদেবী যদি একই পরমেশ্বরের প্রকাশ হয় তবে সমস্যা কোথায়?
বরঞ্চ আমরা তাদের থেকে শিখতে পারি। আমার মতামত হল, আমরা শিবপূজা, বিষ্ণুপূজা, কালীপূজা সকল পূজাতেই তুলসী পাতা, বেলপাতা, জবা ফুল দিয়ে করবো। তাতে আমাদের মধ্যে আলাদা আলাদা উপাস্য বিগ্রহ হলেও, তারা যে সকলেই একই ব্রহ্মের বিভিন্ন রূপ- এ উপলব্ধির পূর্ণতা পাবে ব্যাবহারিকভাবে।ফুল-পাতা কোন বিষয় নয়, শুধুমাত্র ভক্তিটা থাকলেই হবে। ভগবান অন্তর্যামী, তিনি শুধু ভাবটুকুই নেন, তাইতো তাকে বলা হয়- "ভাবগ্রাহী জনার্দনঃ"।বিষয়টি আমাদের বিভিন্ন শাস্ত্রগ্রন্থে পাওয়া যায়। দেবীপুরাণে আছে,
অলাভেন চ পষ্পাণাং পত্রাণ্যপি নিবেদয়েৎ।
পত্রাণামপ্যলাভে তু ফলান্যপি নিবেদয়েৎ।।
ফলানামপ্যলাভে তু তৃণগুল্মৌষধান্যপি।
ওষধীনামলাভে তু ভক্ত্যা ভবতি পূজিতা।।
(দেবীপুরাণ : ১২৩ অধ্যায়,১৯-২০)
"পূজাতে কোথাও যদি ফুল পাওয়া না যায়, তবে ফুলের অভাবে ফুলের পাতা নিবেদন করবে। পাতাও যদি না পাওয়া যায়, তবে শুধু ফল দিয়ে পূজা করবে। ফল পাওয়া না গেলে, তৃণ-গুল্ম-ঔষধি প্রদান করবে। কিন্তু যদি ঔষধিও পাওয়া না যায়, তবে কেবলমাত্র ভক্তিবলেই দেবীকে পূজা করবে।"
শ্রীচণ্ডীতে মধ্যমচরিত্রে মহালক্ষ্মীর হাতে ঘন্টা দেখা যায়। কিন্তু আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের লক্ষ্মীপূজাতে ঘন্টা বাজানো নিষেধ। কেউ ঘন্টা বাজালে আমাদের মা-মাসি-পিসিরা এসে নিষেধ করে।তাদের কি দোষ, আবহমানকাল থেকে তাদের শিখানো হয়েছে মা লক্ষ্মী ঘন্টাবাদ্য একদমই সহ্য করতে পারে না ; যে ঘন্টা বাজাবে তার গৃহেরও ঘন্টা বেজে যাবে ইত্যাদি কথা। অথচ শাস্ত্রে আছে, "সর্ববাদ্যময়ং ঘন্টা"। এ ঘন্টার মতই প্রচলিত মতে বিভিন্ন পূজায় বিভিন্ন বাদ্য নিষিদ্ধ। কোথাও ঢাক নিষিদ্ধ, কোথাও সানাই ইত্যাদি।
উপাস্য রুচির বৈচিত্রের জন্যে একই ব্রহ্মের আলাদা আলাদা রূপের প্রকশে বিভিন্ন রূপে তাঁকে আমরা আরাধনা করি। তবে ব্রহ্মের এ একত্বের জ্ঞান সম্যকরূপে না থাকায়; শুধুমাত্র প্রকাশ বিভিন্ন হওয়ার কারণে বিভিন্ন স্বরূপ দেখে মায়ার প্রভাবে আমরা প্রতিনিয়ত বিভ্রান্ত হয়ে যাই। ভেবে বসি তিনি বুঝি বহু। সর্বদা মনে রাখতে হবে, আমরা এক পরমেশ্বর ছাড়া দ্বিতীয় কারোই উপাসনা করি না। বৈদিক বিভিন্ন মন্ত্রে অত্যন্ত সুন্দর এবং স্পষ্ট করে বিষয়টা বলা আছে:
ইন্দ্রং মিত্রং বরুণমগ্নি-মাহু রথো
দিব্যঃ স সুপর্ণো গরুত্মান্।
একং সদ্বিপ্রা বহুধা বদন্তি
অগ্নি যমং মাতরিশ্বানমাহুঃ।।
(ঋগ্বেদ: ১.১৬৪.৪৬)
"সেই সদ্বস্তু অর্থাৎ পরব্রহ্ম এক ও অদ্বিতীয়। কিন্তু জ্ঞানীগণ তাঁকেই ইন্দ্র, মিত্র, বরুণ, অগ্নি, দিব্য (সূর্য্য), সুপর্ণ, গরুড়, যম, বায়ু ইত্যাদি বিভিন্ন নামে অভিহিত করে থাকেন।"
ন দ্বিতীয়ো ন তৃতীয়শ্চতুর্থো নাপুচ্যতে।
ন পঞ্চমো ন ষষ্ঠঃ সপ্তমো নাপুচ্যতে।
নাষ্টমো ন নবমো দশমো নাপুচ্যতে।
য এতং দেবমেক বৃতং বেদ।।
(অথর্ববেদ:১৩.৪.২)
"পরমাত্মা এক, তিনি ছাড়া কেহই দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম, নবম বা দশম ঈশ্বর বলে অভিহিত হয় না। যিনি তাঁহাকে শুধু এক বলে জানেন একমাত্র তিনিই তাঁকে প্রাপ্ত হন।"
সাকার নিরাকার বিভিন্ন বৈচিত্র্যময় স্বরূপে তিনি যে একজনই এ বিষয়টি তৈত্তিরীয় আরণ্যকের দশম প্রপাঠকের একাদশ অনুবাকের একটি শ্রুতিতে অত্যন্ত সুন্দরভাবে বর্ণনা করা আছে।
তস্য শিখায়া মধ্যে পরমাত্মা ব্যবস্থিতঃ।
স ব্রহ্ম স শিব স হরিঃ সোহক্ষরঃ পরম স্বরাট।।
"জীবের হৃদয়ে পরমাত্মা অবস্থিত। তিনিই ব্রহ্ম, তিনিই শিব, তিনিই হরি, তিনিই ইন্দ্র। তিনি অক্ষর, স্বয়মদীপ্ত রাজা, তিনিই জীবের শ্রেষ্ঠ গতি।"
এক সূর্যের নিচে যদি একহাজার জলভরা কলশি রেখে একজনকে দেখতে বলা হয়, তবে যে জ্ঞানী সে বলবে আমি এক সূর্যের নিচে রাখা হাজারটা কলশির জলে হাজারটা একই সূর্যের প্রতিবিম্ব দেখছি। পক্ষান্তরে যে অজ্ঞানী সে বলবে আমি আলাদা আলাদা হাজারটা সূর্য দেখছি। এক এবং বহুত্বে সেই একজনই। তিনিই এক, তিনিই বহু। পার্থক্য শুধুমাত্র জ্ঞানী ও অজ্ঞানীর দেখার ভঙ্গিতে।এ বিষয়টি বেদাদি-পৌরাণিক শাস্ত্রগ্রন্থাদিতে তো আছেই, অসংখ্য কবিরাও এ বিষয় নিয়ে লিখেছেন। এদের মধ্যে মধ্যযুগের সমাপ্তিকালের কবি রামপ্রসাদ সেন অন্যতম। তিনি এক ব্রহ্মকে দ্বিধা না ভাবতে আমাদের স্মরণ এবং সতর্ক করে দিয়েছেন তার অসাধারণ একটি কালজয়ী গানে। তিনি বলেছেন:
"শাক্তে বলে তুমি শক্তি, শিব তুমি শৈবের উক্তি,
সৈরি বলে সূর্য্য তুমি, বৈরাগী কয় রাধিকাজী,
গাণপত্য বলে গণেশ, যক্ষ বলে তুমি ধনেশ,
শিল্পী বলে বিশ্বকর্মা, বদর বলে নায়ের মাঝি,
শ্রীরামদুলাল বলে, বাজি নয় এ যেন ফলে
এক ব্রহ্ম দ্বিধা ভেবে মন আমার হয়েছে পাজি।"
এক ব্রহ্মের একত্বের উপলব্ধিতে আমরা সকল দেবদেবী পূজার ভিন্ন ভিন্ন উপাচারে প্রত্যেক দেবদেবীকেই আরাধনা করতে চাই। কারণ বিভিন্ন নামে আমরা শুধুমাত্র একজনকেই উপাসনা করি। আমরা রুচির বৈচিত্র্যময়তার জন্যে বিভিন্নভাবে তাকে কল্পনা করি, কিন্তু তিনি বহু নন। তিনি একই, তাই তো তিনি বলেছেন, আমি এক এবং অদ্বিতীয়; 'একমেবাদ্বিতীয়ম্।' সর্বত্রই সেই একেরই খেলা, বহু কেবল বুদ্ধির কলুষতায়। তাইতো সাধক কবি রজনীকান্ত সেন বলেছেন:
"আছ, অনল-অনিলে, চিরনভোনীলে,
ভূধরসলিলে, গহনে,
আছ, বিটপীলতায়, জলদের গায়,
শশীতারকায় তপনে,
আমি, নয়নে বসন বাঁধিয়া,
ব’সে, আঁধারে মরি গো কাঁদিয়া;
আমি, দেখি নাই কিছু, বুঝি নাই কিছু,
দাও হে দেখায়ে বুঝায়ে।"
ঈশ্বরকে সকল ভাবেই উপাসনা করা যায়।মূর্ত এবং অমূর্ত উভয় উপাসনাই আমাদের ধর্মে স্বীকৃত।ঈশ্বর শুধুমাত্র কোন পাঁচতলা, সাততলা, দশতলা আকাশের উপরে অদৃশ্য জগতে একটি চেয়ারে পাপপুণ্যের ক্যালকুলেটর হাতে বসে নেই ; তিনি সর্বভূতে বিরাজ করেন। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ব্যাপী তাঁর আসন। বিভিন্ন ভাবে এবং রূপে তাঁকে আমরা উপাসনা করতে পারি। ঈশ্বরের কোন প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। ভালোর জগতের একজন ঈশ্বর এবং মন্দ জগতের আরেকজন ঈশ্বর বলে কিছু নেই। ভালমন্দ সকল শক্তির উৎসই তিনি। তিনি কোন একচোখা হিংসুক নন। ঈশ্বর জগতের সকলকে তার অনুসারী বানাতে হিংস্র মনোভাব নিয়ে মানুষে মানুষে যুদ্ধে লেলিয়ে দেন না। অবশ্য ঈশ্বরের নামে জগতে কিছু ব্যক্তিকেন্দ্রিক প্রচলিত মতবাদ রয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, কিছু কিছু ব্যক্তিকেন্দ্রিক ধর্মীয় মিতবাদে হিংসাত্মক মানবতা বিরোধী অমানবিক কর্মকাণ্ডকে ধর্মের আবশ্যকীয় অঙ্গ করা হয়েছে। এদের কারণেই ধর্মীয় বিশ্বাস প্রশ্নবিদ্ধ হয়।ভগবান চিন্তার অতীত, তিনি সাকার না, নিরাকারও না। অসীম অনন্ত পরমেশ্বরকে চিন্তার মধ্যে আনতেই আমরা প্রতিমা বা রূপকে তাঁকে উপাসনা করি। শ্রদ্ধা, প্রেম, ভক্তি, বাৎসল্য ইত্যাদি বিভিন্ন ভাবে রসে আমরা তাঁর উপাসনা করি। বিষয়টি শ্রীমদ্ভাগবতের দশম স্কন্ধের উনত্রিশ অধ্যায়ে অসাধারণ করে বলা আছে।
উক্তং পুরস্তাদেতত্তে চৈদ্যঃ সিদ্ধিং যথা গতঃ।
দ্বিষন্নপি হৃষীকেশং কিমুতাধােক্ষজপ্রিয়াঃ।।
নৃণাং নিঃশ্রেয়সার্থায় ব্যক্তির্ভগবতাে নৃপ।
অব্যয়স্যাপ্রমেয়স্য নির্গুণস্য গুণাত্মনঃ।।
কামং ক্রোধং ভয়ং স্নেহমৈক্যং সৌহৃদমেব চ।
নিত্যং হরৌ বিদধতাে যান্তি তন্ময়তাং হি তে৷৷
(শ্রীমদ্ভাগবত: ১০.২৯.১৩-১৫)
"ভগবান অব্যয়, অপ্রমেয়, নির্গুণ এবং সকল গুণের নিয়ন্তা; তাঁর অবতাররূপে দেহধারণ অন্য মানবের মত নয়। জগতের মঙ্গলের জন্যেই তাঁর আবির্ভাব। গোপীদের প্রেমই হোক, শিশুপাল প্রভৃতির ক্রোধই হোক, কংস প্রভৃতির ভয়ই হোক, নন্দ প্রভৃতির স্নেহই হোক, ভক্তের ভক্তিই হোক, তত্বজ্ঞানীর শ্রদ্ধাই হোক আর যুধিষ্ঠির প্রভৃতির সম্বন্ধই হোক - যে কোন প্রকারে ভগবানে আসক্তি জন্মালে তাই মুক্তির কারণ হয়। ভগবানের প্রতি প্রেম, ক্রোধ, ভয়, স্নেহ, ভক্তির যে কোন একটির দ্বারাই তাঁর কৃপা লাভ করে মুক্তিলাভ করা সম্ভব।"
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।
মন্তব্যগুলো দেখুনমন্তব্যগুলো লুকান🙁