মানবজীবনের যদি চরম সত্য বলে কিছু থাকে, সে সত্যের নাম মৃত্যু। আমরা মৃত্যু থেকে দূরে থাকতে চাই, ভয় পাই। যত বেশী ভয় পাই, মৃত্যু ততই আমাদের চারপাশ ঘিরে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে। কিন্তু মৃত্যু যদি হয় সারাজীবনের করা নিষ্কাম কর্মের পরে সাঁজের প্রদীপের মত বিধাতা পুরুষের হাতে সমর্পণ, তবে ভয়ের কিছুই নেই। সর্বদা যদি এমন অনুভূতি অনুভব করা যেত; তবে মৃত্যুভীতি কিছুটা হলেও হয়ত আমাদের কাটত। মৃত্যু নিয়ে ভয় পাওয়ার কিছুই নেই। যেখানেই মৃত্যু সেখানেই জন্ম; যেখানেই লয়, সেখানেই সৃষ্টি। গত কিছুদিন আগে অস্ট্রেলিয়াতে সংগঠিত ভয়ংকর দাবানলে অসংখ্য বনাঞ্চল পুরে বড় বড় গাছগুলি কালো কয়লা হয়ে যায়।কিন্তু কিছুদিন পরে দেখা গেল, সেই মৃত মনে করা কালো কয়লা হওয়া গাছগুলিতেই আবার নতুন পাতা অঙ্কুরিত হয়ে বনাঞ্চলগুলি সজীব হওয়া শুরু হয়েছে।
মৃত্যু প্রত্যেকের জীবনেই নিশ্চিত।তাই আমাদের প্রার্থনা করা উচিত, গাছের একটি পাকা ফল আম বা পেপে পেকে টশটশে হয়ে যেভাবে নিজেই ঝরে পরে; ঠিক সেভাবেই পূর্ণায়ু পেয়ে আমরা যেন আমাদের দেহরূপ প্রদীপকে যাঁর থেকে এসেছি, তাঁর কাছেই সমর্পণ করতে পারি। মহাকাল রুদ্রের প্রতি সমর্পিত বেদের মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্রে এ ভাবটিই প্রকাশিত হছেন।
ত্র্যম্বকং যজামহে সুগন্ধিং পুষ্টিবিদর্দ্ধনম্।
উর্বারুকমিব বন্ধনান্ মৃত্যোর্মুক্ষীয় মামৃতাৎ।।
(ঋগ্বেদ সংহিতা:০৭.৫৯.১২)
"অতীত,বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বা জন্ম,জীবন ও মৃত্যু -এ ত্রয়ীদ্রষ্টা রুদ্ররূপ হে পরমেশ্বর, তোমার বন্দনা করি।তুমি আমাদের বেঁচে থাকার জন্য সুন্দর পরিবেশ ও পুষ্টিকর খাদ্যের দাতা।পাকা উর্বারুক ফলের ন্যায় আমরা যেন পূর্ণায়ু পেয়েই মৃত্যুর বন্ধন হতে মুক্ত হতে পারি। তোমার অমৃতরূপ হতে যেন বঞ্চিত না হই।"
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও চেয়েছেন, দেহকে কোন কাটাছেঁড়া না করে অক্ষত পাকা ফলের মত জীবন দেবতাকে সমর্পণ করতে। তাই শেষবয়সে যে অপারেশনে তাঁর মৃত্যু হয়, এ অপারেশনটি করতে তিনি তীব্র আপত্তি জানিয়েছিলেন।তখন ডা. বিধানচন্দ্র রায় সহ অন্য ডাক্তারদের পিড়াপীড়িতে তিনি শেষ পর্যন্ত অপারেশন করতে সম্মত হন। অপারেশন ঠিকই হয়, কিন্তু তিনি আর সুস্থ হয়ে আমাদের মাঝে ফিরে আসেননি।
সৃষ্টির শুরু থেকেই যে মহাকালের যাত্রাপথ অবিচ্ছিন্নভাবে চলছে, এ যাত্রাপথে আমাদের অস্তিত্ব সামান্য কতক সময়ের জন্যে। আমরা যদি কিছু সময়ের জন্যে খুব একাগ্রভাবে মনকে কেন্দ্রীভূত করে দেহের বাইরে নিয়ে আসতে পারি, তবে মনে হবে এক অসীম মহাশূন্যতার অন্ধকারে আমি একা। আমার আশেপাশে কেউ নেই, শুধুই ঘন অন্ধকার। এভাবে বেশীক্ষণ থাকলে একসময় মহাজাগতিক একাকীত্ব বোধ হতে থাকে। তখন সীমাহীন অন্ধকারে তীব্র ভয় চলে আসবে মনে। পরে চোখখুলে কিছু সময়ের জন্যে আমাদের আশেপাশের পরিবার পরিজন ঘরবাড়ি সহ দৃশ্যমান অনেককিছুই চিনতে কষ্ট হবে। তখনই দেহখাঁচার ভিতরে অচিনপাখির অস্তিত্ব কিছু সময়ের জন্য হলেও টের পাওয়া যায়। স্পষ্ট বোঝা যায়, এ দেহের ভেতরেও দেহহীন দেহ আছে, যাকে ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না, দেখা যায় না, শুধুই অন্তঃকরণ শুদ্ধ হলে হলে তাকে উপলব্ধি করা যায়। যার অস্তিত্ব না থাকলে এ সাধের দেহ জীর্ণবস্ত্রাদিতে পরিণত হয়, সে অবস্থাকেই বলি আমরা মৃত্যু।
অথর্ববেদের কালসূক্তীয় মন্ত্রে মহাকালকে খুবই সুন্দর করে বর্ণনা করা আছে। মহাকালকে আমরা ঈশ্বরের ধ্বংসের রূপ হিসেবে পূজা করি। যে মহাকাল জীবন হরণ করে, তাঁকেই আমরা পূজা করি। প্রত্যেকটি শ্মশানে মহাকাল রূপি শিব এবং তাঁর শক্তি মহাকালীর পূজা করি আমরা। প্রতিদিন প্রতিক্ষণই জন্ম হচ্ছে এবং মৃত্যু হচ্ছে। মৃত্যুতে দেহ পরে থাকে, আত্মা শুধু জন্মমৃত্যুর চক্রাকারে আবর্তিত হতে হতে মুক্তির বা বন্ধনের দিকে এগিয়ে যায়। কোন মৃত্যুতে জীব বদ্ধ হচ্ছে, অথবা কোথাও পাচ্ছে মুক্তি। এভাবেই আত্মার জন্মজন্মান্তরের পথপরিক্রমা চলছে।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জন্ম ও মৃত্যু নামক দুই চিরন্তন সত্যকে আনন্দের উৎসব বলে অবিহিত করেছেন। যেহেতু জন্মতে জীবাত্মার যে যাত্রা শুরু হয়, মৃত্যুতে সেই আত্মাই শুদ্ধ হয়ে বিদেহ মুক্ত হয়। তাই এ নিয়ে বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়:
"নাচে জন্ম নাচে মৃত্যু পাছে পাছে,
তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ।
কী আনন্দ, কী আনন্দ, কী আনন্দ
দিবারাত্রি নাচে মুক্তি নাচে বন্ধ-"
আমার জীবনে দেখেছি যারা শুধুই বাঁচতে চেয়েছে, অনেকদিন বেঁচে থাকতে চেয়েছে, জীবনকে উপভোগ করতে চেয়েছে, তারা খুব একটা বেশীদিন বাঁচতে পারেনি। কিন্তু যারা মরে যাওয়ার কথা মুখেমুখে সারাদিন বলত। এদের দেখেছি শতবছর বা শতবছরের কাছাকাছি বাঁচতে। আমার মায়ের দিদিমা বাল্যবিধবা এক বুড়ামা ছিল।তিনি ঘরে কেউ আসলে তাকেই বলতেন, "রামকে বলবা আমারে যেন নিয়া যায়। আর বাঁচতে ইচ্ছা করে না। এত মানুষরে নেয় আমাকে ক্যান নেয় না?" মনে যাই থাক মুখে মুখে এত মারা যাওয়ার কথা বলা বুড়ামা শতবছরের উপরে বেঁচেছিলেন। খুব একটা রোগব্যাধি ছিল না বল্লেই চলে। একবার কোন একটি সামান্য রোগে কয়েকটি ওষুধ খেতে হয় তার, এতে সেরেও যান। কিন্তু তার ওষুধের বাতিক চেপে যায়। প্রতিদিনই তাকে ক্যাপসুল দিতে হবে। কিন্তু অপ্রয়োজনীয় ওষুধ খাওয়ানো তো ঠিক নয়, আরও বৃদ্ধ বয়সে। বিষয়টি চিন্তা করে এক বুদ্ধি বের করা হল যে, বুড়ামার জন্যে বরিশালের একটি ওষুধের ফ্যাক্টরি থেকে ক্যাপসুলের খালি খোসা নিয়ে আসা হল। খালি খোসাগুলিই ওষুধের মত করে সময় করে তাকে খাওয়ানো হল। ক্যাপসুলের খালি খোসাকে ওষুধ মনে করে খেয়ে বুড়ামা অনেক খুশী। তাকে যদি জিজ্ঞেস করা হত, কেমন বোধ করছ বুড়ামা? বুড়ামার উত্তর, "খুউব ভাল, এইগুলা না খাইলে বাঁচতামই না।" আশ্চর্যজনক যে, বার্দ্ধক্যজনীত কারণে বুড়ামা চোখে দেখতেন না; কিন্তু এই খালি ক্যাপসুলগুলি খাওয়ার কিছুদিন পরে থেকেই, তার মানসিক জোর এতটা বেড়ে যায় যে, সে তখন কিছুটা চোখে দেখাও শুরু করে। তার সামনে কে কোন রঙের শাড়ি পরে আছে তা তিনি তখন বলতে পারতেন। যে বুড়ামা সবাইকে মুখেমুখে মৃত্যুকামনার কথা বলতেন, সেই তিনিই এমনিতেই ওষুধ খেতে চাইতেন। রোগের উপসর্গ না থাকলেও, বার্দ্ধক্য অবস্থায় ওষুধ খেলে তিনি আরও বেশি সুস্থ থাকতে পারবেন।এমনিতে শরীরের ভিতরে রোগব্যাধি থাক বা না থাক, এ ওষুধ নামক খালি ক্যাপসুলের খোসা তাকে মানসিকভাবে এতটা শক্তিশালী করেছিল যে, প্রায় শতবর্ষী তিনি হঠাৎ করে চোখে দেখাও শুরু করেছিলেন। বিষয়টি আশ্চর্যের। বাউল লোককবিরা এই কারণেই বলেছেন:
"একটা চাবি দিয়া দিছে ছাইড়া,
চলতে আছে জনম ভইরা।
মন আমার দেহ ঘড়ির সন্ধান করি,
বানাইয়াছে কোন মিস্তিরি।"
যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণই আশ, এবং ততক্ষণই দেহঘড়িতে বসবাস। মানুষ মরতে চেয়েও বাঁচার আশা করে। এ কারণেই দেখা যায়, যারা আত্মহত্যা করে মারা গিয়েছেন, তারাও শেষ মুহুর্তে মৃত্যুর পূর্বে বাঁচতে আপ্রাণ চেষ্টা করে। বিষয়গুলি নিয়ে বাঙালির অনেক মজার গল্পও আছে। একবার একলোক জঙ্গলে আত্মহত্যা করতে যাচ্ছে। পথে একজন জিজ্ঞেস করছে ভাই কোথায় যাচ্ছেন? যিনি আত্মহত্যা করবেন তিনি উত্তর দিলেন, "মরতে যাচ্ছি।" অন্যজন তখন জিজ্ঞেস করলেন, মরতে ত যাচ্ছেন বুঝলাম, কিন্তু আপনার হাতে হারিকেন কেন? আত্মহত্যা করতে চাওয়া লোকটির তাৎক্ষণিক স্বাভাবিক উত্তর , "পথে যদি সাপে কামড়ায় তাই হাতে হারিকেন নিয়ে যাচ্ছি।" গল্পটা যদিও মজার; কিন্তু এরমধ্যেও অনেক শিক্ষা রয়েছে ।
অনেকে কথায় কথায় বলে, "মরে গেলে বাঁচতাম।" মরে গেলেই যদি কেউ বাঁচতে পারত, তাহলে সবাই এত বাঁচতে চাইত না। আসলে বিষয়টি মরারও না, বাঁচারও না। যে যতটুকু পরমায়ু নিয়ে জগতে এসেছে, সে ততটুকুই ভোগ করবে। বাউলদের ঘড়িতে চাবি দেয়া গানের মত, যোগীরা বলে থাকে আমাদের জন্যে নিঃশ্বাস প্রশ্বাস নির্দিষ্ট। অর্থাৎ একটা দেহ কতবার নিঃশ্বাস নিবে তা আগের থেকেই দৈবনির্দিষ্ট। আমরা যোগের মাধ্যমে যদি এ নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের গতিকে মন্থর করতে পারি, তবেই আমরা বেশী দিন বেঁচে থাকতে পারব। প্রাণীজগতে দেখা যায়, যে সকল প্রাণীদের বুদ্ধিমত্তা আছে তাদের মধ্যে যারা দ্রুত নিঃশ্বাস এবং প্রশ্বাস নেয় এবং ছাড়ে তারা দ্রুতই মারা যায়, যেমন-কুকুর। সে জিব বের করে প্রতিক্ষণ নিঃশ্বাস নিতেই থাকে। আবার কচ্ছপ সহ অনেক প্রাণী আছে যারা অনেকক্ষণ পরপর নিঃশ্বাস নেয়, তারা শতশত বছর বেঁচে থাকে। যোগীদের মতে, দীর্ঘজীবী হওয়ার অন্যতম প্রক্রিয়া হল পবন রূপ বাতাসের বিজয়। এ জগত এবং দেহ বাতাসের খেলা। এ দেহে প্রাণ, অপান, সমান, উদান এবং ব্যান এ প্রাণরূপ বাতাস বাস করে। আমরা ভেসে আছি বাতাসের সাগরে। দেহের ভেতরে এ পঞ্চবাতাস আমাদের জীবিত রাখে। অর্থাৎ দেহের ভেতরেও বাতাস, বাইরেও বাতাস। আর বাতাস চলে গেলে হয়ে মৃত, পরিত্যক্ত। বিষয়টি অনেকে উপলব্ধি করতে পারি, আবার অনেকেই পারি না।
মুত্যুকে ভয় পাওয়া নয়, তাকে স্বাভাবিকভাবে মোকাবেলা করাটাই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের যতটা না বনের বাঘে খায়, এর থেকে মনের বাঘে বেশী খায়। ভয় পেয়ে কি করব? বাঁচতে পারব মৃত্যুর হাত থেকে? না পারব না, তবে চেষ্টা করতে হবে আমি আমার নিদিষ্ট দায়িত্ব নিষ্কামভাবে পালন করে, জীবনকে জয় করে যেন শতবছর পূর্ণায়ু প্রাপ্ত হতে পারি। মৃতুকালে যেন কামনা বাসনার সুবর্ণপাত্রের আবরণ সরিয়ে সেই হিরণ্ময় পুরুষকে দর্শন করে, জগতের পোষক সত্যধর্ম রূপ তাঁকে দর্শন করতে পারি, তাঁর সাথে একাকার হতে পারি। শুক্ল যজুর্বেদে (৪০.১৫) ঠিক এমনই একটি মন্ত্র আছে:
হিরণ্ময়েন পাত্রেণ সত্যস্যাপিহিতং মুখম্।
তত্ত্বং পূষন্নপাবৃণু সত্যধর্মায় দৃষ্টয়ে।।
জীবন ক্ষণস্থায়ী, এতে তরঙ্গের বুদবুদের মত জন্মমৃত্যু আসছে যাচ্ছে। এর মধ্যে সম্পর্কের সম্পর্কের খেলা খেলছি আমরা। সম্পর্কগুলি অধিকাংশই বর্তমান এবং ভৌগোলিক হয়। অনেক কাছের মানুষ দূরে চলে যায় ভৌগোলিক দূরত্বের কারণে, আবার অনেক দূরের মানুষ কাছে চলে আসে ভৌগোলিক কাছাকাছির কারণে।মৃত্যুগুলো সাময়িক আমাদের থমকে দেয়। আবার একটা সময়ে এ প্রিয়জনের মৃত্যু শোককে জীবনের আনন্দে ভুলে যাই। এটাই ভবিতব্য। এটাই বাস্তবতা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম সহ অনেক বড় বড় ব্যক্তিদের জীবনে দেখা যায়, তাদের প্রিয়জনের মৃত্যু তাদের আরো সৃষ্টিশীল করেছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অল্পবয়সে তাঁর লেখার অনুপ্রেরণাদায়ী নতুনবৌঠান কাদম্বরী দেবীকে হারানো, এরপরে প্রিয়তমা স্ত্রী মৃণালিনী দেবী, কন্যাদের মৃত্যু। এ অংসখ্য প্রিয়জনের মৃত্যু তাকে ব্যথিত করেছে, কিন্তু স্তব্ধ করতে পারেনি।"কোন আলোতে প্রাণের প্রদীপ" গানটি তাঁর পিতার মৃত্যু উপলক্ষ্যে লেখা ; প্রিয় নতুন বউঠান কাদম্বরী দেবীর মৃত্যুর পরে লিখলেন, "আমার প্রাণের পরে চলে গেল কে বসন্তের বাতাসটুকুর মতো"- এ হৃদয়ছোঁয়া গানটি; "কেন যে এই দুয়ারটুকু" গানটি তাঁর বড়মেয়ের মৃত্যুর সময়ে ১৯২৫ সালে লেখা; এবং অত্যন্ত মর্মস্পর্শী "আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু" গানটি প্রিয়তমা স্ত্রীর মৃত্যুর পরে লিখেছিলেন। মৃত্যুকে ভয় না পেয়ে, মৃত্যুরূপ মহাসিন্ধুর পারে বিরাজিত অনন্ত আনন্দকে জয় করার ভাবটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনেক গানেই দেখা যায়।
"আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।
তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে॥
তবু প্রাণ নিত্যধারা, হাসে সূর্য চন্দ্র তারা,
বসন্ত নিকুঞ্জে আসে বিচিত্র রাগে॥
তরঙ্গ মিলায়ে যায় তরঙ্গ উঠে,
কুসুম ঝরিয়া পড়ে কুসুম ফুটে।
নাহি ক্ষয়, নাহি শেষ, নাহি নাহি দৈন্যলেশ-
সেই পূর্ণতার পায়ে মন স্থান মাগে॥"
এ গানটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯২৩ সালে কবি সুকুমার রায়ের মৃত্যুসজ্জায় গেয়েছিলেন। গানের প্রত্যকটি কথা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের জীবন তরঙ্গের মত, কখনও এ তরঙ্গ মিলায়ে যায় আবার নতুনভাবে তরঙ্গ উঠে জীবনসমুদ্রে। জন্মজন্মান্তরে মুক্তির কুসুম কখনও ঝরে পড়ে, আবার যখন কুসুম ফুটে, জীব মুক্ত হয়। হতাশার কিছুই নেই, জগতে যেমন দুঃখ আছে, মৃত্যু আছে, বিরহদহন আছে, তেমনি আছে প্রাণে শান্তি, আনন্দ, অনন্তের নিত্যধারা।সেই পূর্ণতার মন যুক্ত হলেই সূর্য চন্দ্র তারা সহ বিশ্ব মুক্তি আনন্দে হাসে। পূর্ণ সেখানে নেই কোন ক্ষয়, নেই কোন দৈন্যলেশ। পাশাপাশি বসে থাকে, জন্ম আর মৃত্যু; দুজনের মাঝখানে ফাঁক ভারি সূক্ষ্ম।
এই জন্মমৃত্যু যে পাশাপাশিই বসবাস করে, এই বিষয়টি রামায়ণের উত্তরকাণ্ডেও পাওয়া যায়। শ্রীরামচন্দ্রের নির্দেশে জনক তনয়া সীতাদেবীকে গঙ্গাতটে মহর্ষি বাল্মীকির আশ্রমের নিকট নির্দিষ্ট স্থানে রেখে আসলেন লক্ষ্মণ। কিন্তু তিনি অযোধ্যায় ফিরে দেখলেন সীতার বিরহে শ্রীরামচন্দ্র কাতর। তখন লক্ষ্মণ বললেন, জগতের কোন কিছুতেই শোক করা অনুচিত। কালের গতি নির্মমভাবে বয়ে যায়। তাই বুদ্ধিমান ও মনস্বী ব্যক্তিগণ কোন বিষয়েই শোক করেন না। জীবনে উত্থান ও পতন, সংযোগ ও বিয়োগ, জীবন এবং জীবনের অন্তে মৃত্যু- একই সাথে পাশাপাশি পথ চলে।বৃত্তাকারভাবে ঘুরেঘুরে চলে তাদের পথ পরিক্রমা।
সর্বে ক্ষয়ান্তা নিচয়াঃ পতনাস্তাঃ সমুচ্ছ্ৰয়াঃ।
সংযোগা বিপ্রয়োগান্তা মরণান্তং চ জীবিতম্॥
তস্মাৎ পুত্রেষু দারেষু মিত্রেষু চ ধনেষু চ।
নাতিপ্রসঙ্গঃ কর্তব্যো বিপ্রয়োগো হি তৈর্ধ্রুবম্।।
(রামায়ণ : উত্তরকাণ্ড, ৫২.১১-১২)
"সংসারে যত সঞ্চিত বস্তু আছে, তার সবকিছুর পরিণাম বিনাশ, উত্থানের অন্ত পতন, সংযোগের অন্ত বিয়োগ এবং জীবনের অন্ত হল মৃত্যু। সুতরাং স্ত্রী, পুত্র, মিত্র ও ধনে বিশেষ আসক্তি রাখা উচিত নয়। কারণ সেসব থেকে বিয়োগ হওয়া নিশ্চিত।"
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।